Probondo

Kitab


মিরাজের সঠিক ঘটনা ও তার শিক্ষা


মিরাজের ঘটনা কুরআন ও সহীহ হাদীছের মাধ্যমে প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

)سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ(
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীর কিয়দাংশে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশকে আমি করেছিলাম বরকতময়। তাঁকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোত, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বাণী ইস্রাঈলঃ ১)
মেরাজ কখন সংঘটিত হয়েছিল?
মেরাজ কখন হয়েছিল সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দলীল পাওয়া যায় না। সুতরাং ২৭ রজব মেরাজ হওয়ার অনুমান ঠিক নয়। তবে বিশুদ্ধ কথা হল: তায়েফ থেকে ফেরত আসার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। (দেখুন: রাহীকুল মাখতুম) 
মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরেঃ
ইমাম ইবনুল কায়্যেম (রঃ) বলেনঃ বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরে। তিনি প্রথমে বুরাকে আরোহন করে মাসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণ করলেন। জিবরীল ফেরেশতা সাথেই ছিলেন। মসজিদের দরজার হাতলের সাথে বুরাক বেঁধে সেখানে নেমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবীদের ইমাম হয়ে নামায পড়লেন। মাসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘ইসরা অর্থাৎ রাত্রির ভ্রমণ বলা হয়। সেরাত্রেই বায়তুল মাকদিস হতে উর্ধাকাশ পর্যন্ত মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়।
আনাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি একদা কাবাঘরের নিকট ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় হিকমত (জ্ঞান) ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনয়ন করা হলো। আমার বক্ষ হতে পেট পর্যন্ত ফেঁড়ে যমযমের পানি দিয়ে পেটের ভিতরের অংশ ধৌত করে তা ঈমান ও হিকমতের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। তারপর আমার নিকট খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট এবং গাধার চেয়ে বড় একটি সাদা রঙ্গের বুরাক নামক একটি বাহন আনয়ন করা হল। তিনি প্রথমে বুরাকে আরোহন করে মাসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণ করলেন। জিবরীল ফেরেশতা সাথেই ছিলেন। মসজিদের দরজার হাতলের সাথে বুরাক বেঁধে সেখানে নেমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবীদের ইমাম হয়ে নামায পড়লেন। মাসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘ইসরা অর্থাৎ রাত্রির ভ্রমণ বলা হয়।
অতঃপর তিনি সিঁড়ির মাধ্যমে উর্ধাকাশে ভ্রমণ শুরু করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ দুনিয়ার আকাশের নিকটবর্তী হলাম। জিবরীল ফেরেশতা আমার সাথেই ছিল। উপর থেকে আগমণকারীর পরিচয় জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, কে? উত্তরে জিবরীল বললঃ আমি জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হলোঃ আপনার সাথের লোকটি কে? তিনি বললেনঃ মুহাম্মাদ। বলা হলোঃ তাকে কি আসতে বলা হয়েছে? জিবরীল বললেনঃ হ্যাঁ। আকাশের ফেরেশতাগণ বললেনঃ স্বাগতম, শুভ হোক তাঁর আগমণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
প্রথম আকাশে আমি আদম (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি আমাকে স্বাগতম জানিয়ে বললেনঃ আমার ছেলে ও নবীর আগমণ শুভ হোক।
দ্বিতীয় আকাশে যাওয়ার সময় আমাদেরকে একই প্রশ্ন করা হল। সেখানে গিয়ে আমি ঈসা এবং ইয়াহইয়া (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁরা উভয়ই আমাকে সমাদর করলেন এবং স্বাগতম জানালেন।
তৃতীয় আকাশে ইউসূফ (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সালাম দিলাম। তিনিও আমাকে স্বাতম জানিয়ে বললেনঃ আমার ভাই ও নবীর আগমণ শুভ হোক।
এমনিভাবে চতুর্থ আকাশে গিয়ে ইদরীস (আঃ)।
পঞ্চম আকাশে হারুন (আঃ)।
ষষ্ঠ আকাশে মূসা (আঃ)এর সাথে দেখা করলাম। মূসা (আঃ)কে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ! এই ছেলেটিকে আমার অনেক পরে নবী হয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে কিন্তু আমার চেয়ে অধিক সংখ্যক উম্মাত নিয়ে আমার পূর্বেই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
পরিশেষে সপ্তম আকাশে গমণ করলাম। উপর থেকে আগমণকারীর পরিচয় জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করা হলঃ কে? উত্তরে জিবরীল বললেনঃ আমি জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হলোঃ আপনার সাথের লোকটি কে? তিনি বললেনঃ মুহাম্মাদ। বলা হলোঃ তাকে কি আসতে বলা হয়েছে? জিবরীল বললেনঃ হ্যাঁ। আকাশের ফেরেশতাগণ বললেনঃ স্বাগতম, শুভ হোক তাঁর আগমণ। সপ্তম আকাশে গিয়ে ইবরাহীম (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি বললেনঃ আমার সন্তান ও নবীকে স্বাগতম।
মিরাজের রাত্রিতে নবী (সাঃ) যে সমস্ত নিদর্শন দেখেছেনঃ 
মেরাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ
لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا (মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল) তাঁকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে। (সূরা বাণী ইসরাঈলঃ ১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাত্রিতে অসংখ্য বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন। তম্মধ্যে:
১) মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)কে দেখেছেন। তার ডান পাশে ছিলে শহীদদের (জান্নাতীদের) রূহ এবং বাম পাশে ছিল জাহান্নামীদের রূহ।
২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেন: অতঃপর আমার সামনে বায়তুল মামূর উম্মুক্ত করা হলো। বায়তুল মামূর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জিবরীল বললেনঃ এটি হলো বায়তুল মামূর। এতে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে। এক বার যে সেখান থেকে বের হয়ে আসে কিয়ামতের পূর্বে সে আর তাতে প্রবেশের সুযোগ পাবেনা।
৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেন: অতঃপর আমার জন্যে সিদরাতুল মুনতাহা তথা সিমান্তের কূল বৃক্ষ উম্মুক্ত করা হল। এই বৃক্ষের ফলগুলো ছিল কলসীর ন্যায় বড়। গাছের পাতাগুলো ছিল হাতীর কানের মত বৃহদাকার।
৪) তিনি গাছের গোড়াতে চারটি নদী দেখতে পেলেন। দু’টি চলে গেছে ভিতরের দিকে এবং দুটি চলে গেছে বাহিরের দিকে। জিবরীলকে আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ ভিতরের দিকে প্রবাহিত নদী দুটি জান্নাতে চলে গেছে এবং বাহিরের নদী দুটি হলো ফোরাত ও নীল। ফোরাত ও নীল দেখার অর্থ হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর মিশন অচিরেই ঐ নদী দুটির অঞ্চলে পৌঁছে যাবে এবং ঐ সমস- অঞ্চলের অধিবাসীরা যুগে যুগে ইসলামের পতাকা বহন করবে। অর্থ এই নয় যে এদুটি নদী জান্নাত থেকে বের হয়ে এসেছে।
৫) মিরাজের রাত্রিতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় জিবরীল ফেরেশতাকে আসল আকৃতিতে দেখলেন। অথচ ইতোপূর্বে তিনি আরেকবার দুনিয়াতে তাঁকে দেখেছিলেন।
৬) তিনি বেনাযীর শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে,
وَإِنَّا أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ فَيَثْلَغُ رَأْسَهُ فَيَتَهَدْهَدُ الْحَجَرُ هَا هُنَا فَيَتْبَعُ الْحَجَرَ فَيَأْخُذُهُ فَلَا يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ الْمَرَّةَ الْأُولَى
“আমরা এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আসলাম। তার মাথার কাছে পাথর হাতে নিয়ে অন্য একজন লোক দাড়িয়ে ছিল। দাড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মাথায় সেই পাথর নিক্ষেপ করছে। পাথরের আঘাতে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং পাথরটি বলের মত গড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনতে আনতে আবার তার মাথা ভাল হয়ে যাচ্ছে। দাড়ানো ব্যক্তি প্রথমবারের মত আবার আঘাত করছে এবং তার মাথাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সফরসঙ্গী ফেরেশতাদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলেনঃ কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? উত্তরে তারা বললেনঃ এব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছিল। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি এবং সে ফরজ নামাযের সময় ঘুমিয়ে থাকত। কিয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাসস্ত দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী)
৬) তিনি সুদখোরের শাসি- দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে,
فَأَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ حَسِبْتُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ أَحْمَرَ مِثْلِ الدَّمِ وَإِذَا فِي النَّهَرِ رَجُلٌ سَابِحٌ يَسْبَحُ وَإِذَا عَلَى شَطِّ النَّهَرِ رَجُلٌ قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ حِجَارَةً كَثِيرَةً وَإِذَا ذَلِكَ السَّابِحُ يَسْبَحُ مَا يَسْبَحُ ثُمَّ يَأْتِي ذَلِكَ الَّذِي قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ الْحِجَارَةَ فَيَفْغَرُ لَهُ فَاهُ فَيُلْقِمُهُ حَجَرًا فَيَنْطَلِقُ يَسْبَحُ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَيْهِ كُلَّمَا رَجَعَ إِلَيْهِ فَغَرَ لَهُ فَاهُ فَأَلْقَمَهُ حَجَرًا
“আমরা একটি রক্তের নদীর কাছে আসলাম। দেখলাম নদীতে একটি লোক সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে অন্য একটি লোক কতগুলো পাথর একত্রিত করে তার পাশে দাড়িয়ে আছে। সাঁতার কাটতে কাটতে লোকটি যখন নদীর কিনারায় পাথরের কাছে দাড়ানো ব্যক্তির নিকটে আসে তখন দাড়ানো ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পাথর মুখে নিয়ে লোকটি আবার সাঁতরাতে শুরু করে। যখনই লোকটি নদীর তীরে আসতে চায় তখনই তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের সুদখোর”। (সহীহ বুখারী)
৭) তিনি ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎকারীকেও দেখেছেন। তাদের ঠোঁটের আকার আকৃতি ছিল উটের ঠোঁটের মত। তারা পাথরের টুকরোর মত আগুনের ফুলকী মুখের মধ্যে পুরতেছিল এবং সেগুলো পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছিল।
৮) তিনি ব্যভিচারী নারী পুরুষের শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দীর্ঘ হাদীছে কবরে ব্যভিচারীর ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেনঃ
فَأَتَيْنَا عَلَى مِثْلِ التَّنُّورِ قَالَ فَأَحْسِبُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ فَإِذَا فِيهِ لَغَطٌ وَأَصْوَاتٌ قَالَ فَاطَّلَعْنَا فِيهِ فَإِذَا فِيهِ رِجَالٌ وَنِسَاءٌ عُرَاةٌ وَإِذَا هُمْ يَأْتِيهِمْ لَهَبٌ مِنْ أَسْفَلَ مِنْهُمْ فَإِذَا أَتَاهُمْ ذَلِكَ اللَّهَبُ ضَوْضَوْا
“আমরা একটি তন্দুর চুলার নিকট আসলাম। যার উপরিভাগ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশ ছিল প্রশস্ত। তার ভিতরে আমরা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখতে পেলাম তাতে রয়েছে কতগুলো উলঙ্গ নারী-পুরুষ। তাদের নিচের দিক থেকে আগুনের শিখা প্রজ্বলিত করা হচ্ছে। অগ্নিশিখা প্রজ্ব্বলিত হওয়ার সাথে সাথে তারা উচ্চঃস্বরে চিৎকার করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের ব্যভিচারী নারী-পুরুষ”। (বুখারী)
ব্যভিচারীর শাস্তির অন্য একটি চিত্রঃ 
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীল ফেরেশতাক জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কোন শ্রেণীর লোক? জিবরীল বললেনঃ এরা আপনার উম্মতের ঐ সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সাথে রাত্রি যাপন করত। (আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াহ, ডঃ সালেহ ফাওযান)
৯) জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন।
১০) তিনি সেই রাত্রে জাহান্নামের প্রহরী মালেক ফেরেশতাকে দেখেছেন। তাঁর দিকে ফিরে তাকাতেই তিনি আমাকে প্রথমেই সালাম দিলেন। (বুখারী, কিতাবু আহাদীছুল আম্বীয়া, হাদীছ নং- ৩১৮২। মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হাদীছ নং- ২৫১)
১১) বায়তুল মাকদিসে নবীদের ইমাম হয়ে নামায পড়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকালে ঘুম থেকে উঠে সে রাত্রিতে দেখে আসা নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে যখন কুরাইশদেরকে সংবাদ দিলেন, তখন তারা এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর তারা অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। তারা তাঁর নিকট বায়তুল মাকদিসের বর্ণনা পেশ করার দাবী জানালো। আল্ল্লাহ বায়তুল মাকদিসে দৃশ্য তার চোখের সামনে উম্মুক্ত করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখে দেখে সেখানকার সকল নিদর্শন বলে দিলেন। তারা একটি কথাও অস্বীকার করতে পারলনা।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি একদা কাবার প্রাঙ্গনে ছিলাম। কুরাইশরা আমাকে বায়তুল মাকদিসের এমন জিনিষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল যা আমার স্বরণ ছিলনা। এতে আমি সংকটে পড়ে গেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ আমার জন্যে বায়তুল মাকদিসকে চোঁখের সামনে উঠিয়ে ধরলেন। দেখে দেখে আমি তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।
মিরাজের শিক্ষাঃ
১) ঈমানী পরীক্ষাঃ 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে এসে সকালে মানুষের কাছে তা বলতে শুরু করলেন। এ ঘটনা শুনে কতিপয় দুর্বল ঈমানদার মুরতাদ হয়ে গেল। মুশরিকদের কিছু লোক দৌড়িয়ে আবূ বকর (রাঃ) নিকট গিয়ে বললঃ তোমর বন্ধুর খবর শুনবে কি? সে বলছে, আজ রাতের ভিতরেই সে নাকি বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে চলে এসেছে। তিনি বললেনঃ আসলেই কি মুহাম্মাদ তা বলছে? তারা এক বাক্যে বললঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ যদি বলেই থাকে, তাহলে সত্য বলেছেন। তারা আবার বললঃ তুমি কি বিশ্বাস কর যে, সে এক রাতের ভিতরে বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে সকাল হওয়ার পূর্বেই আবার মক্কায় চলে এসেছে? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি এর চেয়েও দূরের সংবাদকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে সকাল-বিকাল আকাশ থেকে সংবাদ আসে। আমি তা বিশ্বাস করি। সে দিনই আবূ বকর (রাঃ) কে পরম সত্যবাদী তথা সিদ্দীক উপাধীতে ভূষিত করা হয়। (হাকেম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৮১, হাদীছ নং- ৩১৮২, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন)
২) দাঈদের জন্য শিক্ষাঃ 
মিরাজের ঘটনায় দ্বীনের দাঈদের জন্য এক বিশেষ শিক্ষা রয়েছে। তিনি মিরাজ থেকে ফেরত এসে মানুষের কাছে ঘটনা খুলে বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে উম্মে হানী বিনতে আবু তালেব (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে, লোকেরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই তাদের কাছে ঘটনা খুলে বলবো। আমাকে তারা মিথ্যাবাদী বললেও। সুতরাং দ্বীনের দাঈগণের উচিত, সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করবে না এবং মানুষ সেটাকে গ্রহণ করবে কি করবে না- এ ধরণের কোন চিন্তা-ভাবনা করবে না; বরং বলিষ্ঠ কন্ঠে মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরবে।
৩) পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়ঃ
মেরাজের রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। মিরাজ থেকে ফেরত আসার সময় ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ হল। মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ কি নিয়ে আসলেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। মূসা (আঃ) আমি মানুষের অবস্থা তোমার চেয়ে অনেক বেশী অবগত। বানী ইসরাঈলকে আমি ভালভাবেই পরীক্ষা করে দেখেছি। তোমার উম্মাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবে না। তুমি ফেরত যাও এবং কমাতে বল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি মূসা (আঃ)এর পরামর্শ মোতাবেক ফেরত গিয়ে কমাতে বললাম। চল্ল্লিশ করা হলো। আবার মূসা আলাইহিস সালামের পরামর্শ মোতাবেক ২য় বার আবদারের প্রেক্ষিতে ত্রিশ করা হলো। পুনরায় যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিশ ওয়াক্ত করে দেয়া হলো। অতঃপর দশে পরিণত হলো। মূসা (আঃ)এর কাছে দশ ওয়াক্ত নিয়ে ফেরত আসলে তিনি আবার যেতে বললেন। এবার পাঁচ ওয়াক্ত করা হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়ে মূসা (আঃ)এর কাছে আগমণ করলাম। তিনি আমাকে আবার যেতে বললেন। আমি তাঁকে বললামঃ আমি গ্রহণ করে নিয়েছি। তখন আল্ল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষণা করা হলোঃ আমার ফরজ ঠিক রাখলাম। কিন’ বান্দাদের উপর থেকে সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। আর আমি প্রতিটি সৎআমলের বিনিময় দশ পর্যন- বাড়িয়ে দিব। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায সঠিকভাবে আদায় করলে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের ছওয়াব দেয়া হবে। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবু বাদইল খাল্‌ক, হাদীছ নং- ৪৪৫৮, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হাদীছ নং- ২৩৮)
৪) আল্লাহ্‌ তাআলা যে আরশে আযীমে সমুন্নত মিরাজের ঘটনা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। 
৫) সকল ইবাদতের মধ্যে নামায হচ্ছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ইবাদত। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা অন্যান্য ইবাদত জমিনে ফরজ করেছেন। আর নামায ফরজ করেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে কাছে ডেকে নিয়ে সাত আসমানের উপরে। এতে নামাযের গুরুত্বের কথাটি সহজেই অনুধাবন করা যায়।
৬) নামায পরিত্যাগ করা কঠিন অপরাধ। তাই বেনামাযীর শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর।
৭) ব্যভিচার একটি ঘৃণিত কাজ। এর শাস্তিও অত্যন্ত নিকৃষ্ট।
৮) সুদখোরের ভয়াবহ পরিণতি।
মিরাজ সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত বিশ্বাস ও তাঁর প্রতিবাদঃ
ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ ২৭ বছর পর্যন্ত মিরাজে থাকার গল্প কাল্পনিক।
খ) বড় পীরের ঘাড়ে চরে সিদরাতুল মুন্তাহা পার হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছার কিচ্ছা বানোয়াট।
গ) ২৭ রজবে বিশেষ ইবাদত পালন করা বা রজব দিবস পালন করা বিদআত। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ শবে মিরাজ উপলক্ষে কোন ইবাদত করেন নি বা করতে বলেন নি। সুতরাং দ্বীনের ক্ষেত্রে সকল নব আবিস্কৃত বিষয়ই বিদআত, যা থেকে দূরে থাকা সকল মুসলিমের উপর করণীয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় তৈরী করবে যা তার অন্তর্ভূক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম) তিনি আরও বলেনঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে, যে বিষয়ে আমাদের অনুমোদন নেই, তা আমলকারীর উপর প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহীহ মুসলিম)
ঘ) আল্ল্লাহ্‌কে স্বচক্ষে দেখার কথাটি সঠিক নয়। 
ইমাম ইবনুল কায়্যেম (রঃ) আল্লাহকে দেখার ব্যাপারে আলেমদের মতবিরোধ বর্ণনা করেছেন। তবে বিশুদ্ধ কথা হলো, তিনি আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখেন নি। কারণ কোন সাহাবী স্বচক্ষে দেখার পক্ষে কোন বর্ণনা উল্লেখ করেন নি। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, আল্লাহকে দেখার অর্থ হলো অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখা। কপালের চক্ষু দিয়ে দেখা উদ্দেশ্য নয়। (যাদুল মাআদ, (৩/৩০)
আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার ব্যাপারে আয়েশা (রাঃ) এর হাদীস:
عن عَائِشَةَ فَقَالَتْ ثَلَاثٌ مَنْ تَكَلَّمَ بِوَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ قُلْتُ مَا هُنَّ قَالَتْ مَنْ زَعَمَ أَنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَبَّهُ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَة قَالَ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَتَمَ شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ وَاللَّهُ يَقُولُ ( يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّهُ يُخْبِرُ بِمَا يَكُونُ فِي غَدٍ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ وَاللَّهُ يَقُولُ ( قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ )
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে স্বচক্ষে দেখেছেন সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যাচার করল। যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ তিনি গোপন করেছেন, সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যা রচনা করল। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ হে রসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। (সূরা মায়িদাঃ ৬৭) আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম (গায়েবের) আগাম খবর দিতে পারতেন সেও আল্লাহর উপর চরম মিথ্যা রচনা করল।” (তিরমিযী-সহীহ) তিনি আল্লাহর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে ছিলেন এবং অন্তর দিয়ে তা অনুভব করেছেন। কিন’ স্বচক্ষে দেখার কোন দলীল পাওয়া যায় না।
সুতরাং মিরাজ সম্পর্কে সকল কাল্পনিক ও মিথ্যা ঘটনা পরিহার করে তা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের সকলের জন্য জরুরী।