Probondo

Kitab


তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা

তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা





ভূমিকা: আল্লাহ তায়ালা বলেন: 
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্‌র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা নিসাঃ ৫৯)


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: 
আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে সময় আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। (দেখুন: আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুস্‌ সুন্নাহ, তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল ইল্‌ম। ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীছটি হাসান সহীহ। মুসনাদে আহমাদ, (৪/১২৬), মাজমুওয়ায়ে ফাতাওয়া (১০/৩৫৪।)

কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছের অনুরূপ অর্থে আরও অনেক আয়াত ও সহীহ হাদীছ রয়েছে, যার তাৎপর্য হচ্ছে মুসলমানদের উপর আবশ্যক হচ্ছে তারা ফরজ, সুন্নাত ও নফলসহ সকল প্রকার এবাদত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশিত তরীকা অনুযায়ী সম্পাদন করবে এবং তাতে সকল প্রকার বিদআত থেকে বিরত থাকবে। রামাযান মাসে তারাবীর নামায একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত এবাদত। তাই আমাদেরকে এক্ষেত্রেও সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ করে তারাবীর নামাযের রাকআতের ক্ষেত্রে। আসুন আমরা সহীহ হাদীছের আলোকে তারাবীর নামাযের সঠিক রাকআত সংখ্যা জেনে নেই।

তারাবীর নামাযের রাকআত সংখ্যা

রামাযান মাসে কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীর নামাযের সঠিক রাকআত সংখ্যা হচ্ছে বিতরসহ ১১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা রাতের নামায বা তারাবীর নামায এগার রাকআতের বেশী পড়তেন না। উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) থেকে ১১ রাকআত পড়ার কথাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। আর রাতের নামায যেহেতু রাসূল ঘরেই পড়তেন, তাই আয়েশা (রা:) এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানতেন। তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন:
ما كان يزيد في رمضان ولا في غيره عن إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعاً فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعاً فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي ثلاثاً
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায এগার রাকআতের বেশী পড়তেন না। তিনি প্রথমে (দু রাকায়াত দু রাকায়াত করে) চার রাকআত পড়তেন। তুমি তার দীর্ঘ কিয়াম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। তিনি পুনরায় চার রাকআত (দুই রাকআত দুই রাকআত করে) পড়তেন। তুমি তার দীর্ঘ কিয়াম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি ৩ রাকআত বিতর পড়তেন। (বুখারী ও মুসলিম)
সায়েব বিন ইয়াজিদ (রা:) বলেন: 
উমার বিন খাত্তাব (রা:) উবাই বিন কা’ব এবং তামীম দারীকে এগার রাকআত তারাবীর নামায পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। (দেখুন: মুআত্তা ইমাম মালিক)
এটিই আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীছের দাবী। এটিই ছিল অধিকাংশ সাহাবী,তাবেঈ এবং ইমামদের আমল। তারা এগার রাকআতের বেশী তারাবীর নামায পড়তেন না।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) তারাবীর নামাযের রাকআতের ব্যাপারে সকল মত এক স্থানে একত্রিত করেছেন।
১) তিন রাকতআত বিতরসহ ১১ রাকআত।
২) তিন রাকআত বিতরসহ ১৩ রাকআত
৩) তিন রাকআত বিতরসহ ২১ রাকআত
৪) তিন রাকআত বিতরসহ ২৩ রাকআত
৫) তিন রাকআত বিতরসহ ৩৯ রাকআত
৬) তিন রাকআত বিতরসহ ৪১ রাকআত
৭) তিন রাকআত বিতরসহ ৪৯ রাকআত
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী উপরের সবগুলো মত উল্লেখ করার পর বলেন: তবে তারাবীর নামাযের রাকআতের ব্যাপারে আয়েশা (রা:)এর হাদীছ ব্যতীত অন্য কোন হাদীছ সহীহ সনদে প্রমাণিত হয় নি। আর তা হচ্ছে তাঁর কথা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায এগার রাকআতের বেশী পড়তেন না।

বাকী মতগুলোর খণ্ডন:

ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২০ রাকআত তারাবী পড়র হাদীছের সনদ দুর্বল এবং বুখারী ও মুসলিম শরীফে আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীছের রিরোধী। (দেখুন ফতহুল বারী ৬/২৯৫, হাদীছ নং- ১৮৭৪, মাকতাবা শামেলা)
আর বাকী বর্ণনাগুলো সাহাবী, তাবেয়ী এবং তাদের পরবর্তী যুগের আলেমগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তারা যদি কেরাআত দীর্ঘ করতেন তাহলে রাকআত সংখ্যা কম করতেন। আর সংক্ষিপ্ত কেরাআত পাঠ করলে রাকআত সংখ্যা বাড়াতেন।

সার সংক্ষেপ:
সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও উত্তম হচ্ছে, কিরাআত দীর্ঘ করে বিতরসহ ১১ রাকআত তারাবীর নামায পড়া। তবে কতিপয় আলেম বলেছেনঃ তারাবীর নামায ১১ রাকআতের চেয়ে বেশী পড়তে চাইলে কোন অসুবিধা নেই।

শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী এর সংযোজন:
মূলতঃ ১১ রাকাত বা ২০ রাকাত বলে কথা নয়। যে কোন সংখ্যায় মানুষ রাতের নফল নামায পড়তে পারে। যেটা রাসূল (সাঃ) এর কাওলী হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু যদি নির্ধারণ করা হয় যে ৮ রাকাত পড়া সুন্নাত। তাহলে দলীল দরকার। এক্ষেত্রে আমরা রাসূল (সাঃ) এর ফে’লী হাদীছ পাই, যাতে প্রমাণ হয় তিনি ৮ রাকাতই পড়েছেন। সুতরাং ৮ রাকাতই সুন্নাত। কিন্তু বেশী পড়তে চাইলে তার অনুমতি আছে। তাকে বাধা দেয়া যাবে না। এই কারণেই মক্কা-মদীনায় ২০ রাকাত পড়া হয় এবং শেষ দশকে ৩৩ রাকাত পড়া হয়।
 কিন্তু কথা হচ্ছে যদি বলা হয় ২০ রাকাতই সুন্নাত- ৮ রাকাত নয়, তাহলে ২০ রাকাত সুন্নাত বলার পক্ষে সহীহ্ দলীল দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) তো নয়ই, সাহাবায়ে কেরাম থেকেও কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। ওমার (রাঃ) এর ব্যাপারে যে বর্ণনাগুলো উল্লেখ করা হয় তা যঈফ। দলীলের অনুপযুক্ত। বরং ওমার (রাঃ) থেকে মুআত্তা মালেকে ৮ রাকাতের পক্ষেই সহীহ্ বর্ণনা পাওয়া যায়।
 ওমার (রাঃ) থেকে তারাবীহর বিষয়ে ৩ রকমের বর্ণনা পাওয়া যায়,(১) ৩৬ রাকাত, কিন্তু বর্ণনাটি যঈফ। এটি রয়েছে কিয়ামুল্লায়ল মারওয়াযীতে। (৩) ২৩ রাকাত, এ বর্ণনাটিও যঈফ। এটি মুআত্তায় আছে। কারণ যার বরাতে বর্ণনাটি এসেছে তিনি ওমার (রাঃ)এর যুগে জন্ম গ্রহণই করেন নি। (৩) ১১ রাকাত,এটি মুআত্তা মালেকে বর্ণিত হয়েছে। এটি সহীহ বর্ণনা। যেমন আলবানী সাহেব তা সহীহ্ বলেছেন।
রাসূল (সাঃ) থেকে মারফূ সূত্রে ২০ রাকাতের পক্ষে যে হাদীছ উল্লেখ করা হয় তা খুবই দুর্বল বা জাল। বর্ণনাটি বাইহাকী, ত্বাবরানী ও ইবনে আবী শায়বায় উল্লেখ হয়েছে। সে সম্পর্কে বাইহাকী নিজেই বলেন উহা যঈফ।
তাছাড়া হানাফী মাযহাবের আলেমগণও হাদীছটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন। যেমন আল্লামা যাইলাঈ নসবুর রায়া গ্রন্থে,মোল্লা আলী কারী,বদরুদ্দীন আইনী,আনোয়ার শাহ কাশমীরী (রহঃ) প্রমূখগণ উল্লেখযোগ্য।
বদরুদ্দীন আইনী বলেন, ত্বাবারনী ও ইবনে আবী শায়বা বর্ণিত হাদীছটি যঈফ হওয়ার সাথে সাথে বুখারী ও মুসলিমের বর্ণিত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীছের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। (দ্রঃ উমদাতুল কারী-বদরুদ্দীন আইনী, ৫/৩৫৯ মিশরী ছাপা( আল্লামা নাসেরুদ্দীণ আলবানী হাদীছটিকে জাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

একটি সংশয় ও তার অবসান: তারাবী এবং তাহাজ্জুদের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?

প্রশ্ন: সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা কাউন্সিলের সাবেক প্রধান মুফতী সম্মানিত শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (র:)কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারাবী, কিয়ামুল লাইল এবং তাহাজ্জুদের মধ্যে পার্থক্য কি? 
উত্তর: সম্মানিত শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (র:) বলেন: রাতের নামাযকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। একে কিয়ামও বলা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ
“আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়, ওটা তোমার জন্য নফল।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৭৯) 
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلا قَلِيلًا
“ওহে চাদরে আবৃত (ব্যক্তি), রাতে সালাতে দাড়াও, রাতের কিছু অংশ বাদে।” (সূরা মুজাম্মেলঃ ১-২) 
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
“তাদের প্রতিপালক যা তাদেরকে দিবেন, তা তারা ভোগ করবে, কারণ তারা পূর্বে (দুনিয়ার জীবনে) ছিল সৎ কর্মশীল। তারা রাত্রিকালে খুব কমই শয়ন করত।” (সূরা আয-যারিয়াতঃ ১৬-১৭)
আর মানুষের উপর সহজ করে এবং বেশী দীর্ঘ না করে রামাযান মাসে রাতের প্রথম ভাগে কিয়ামুল লাইল করাকে আলেমদের পরিভাষায় তারাবী হিসেবে নাম করণ করা হয়। একে তাহাজ্জুদ এবং কিয়ামুল লাইল হিসেবে নাম করণ করাও জায়েজ আছে। এতে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহই তাওফিক দাতা

আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায
আরবীতে পারদর্শী ভাইদের জন্য ফতোয়ার লিংক দেয়া হল। অনুবাদে ভুল হয়ে থাকলে জানাবেন বলে আশা রাখি।

লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ (লিসান্সঃ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, এম,এম, ফাস্ট ক্লাশ)
সংযোজন: আব্দুল্লাহ আল কাফী (লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী (দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।)
সূত্র: সালাফী বিডি



এ প্রসঙ্গে ডাক্তার জাকির নাইকের বিশ্লেষণ দেখুন (ইংরেজী)