অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুর রব আফফান | সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
প্রথমত: স্থান পরিচিতি
উহুদ: মদীনার একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। বর্তমানেও এ নামে প্রসিদ্ধ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ পাহাড় সম্পর্কে বলেন:
এ উহুদে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল, যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুসহ মুসলিমদের সত্তর জন শহীদ হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁত ভাঙ্গে ও তাঁর সম্মানিত চেহারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
এ ঘটনা ঘটে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের তৃতীয় বছর, দু’বছর নয় মাস সাত দিন পর।[2]
দ্বিতীয়ত: যিয়ারতের বিধান এবং যিয়ারতকারী যা বলবে
উহুদ শহীদগণের কবরস্থানে গিয়ে তাদের প্রতি সালাম ও তাদের জন্য দো‘আ করার উদ্দেশ্যে যিয়ারত করা পুরুষদের ক্ষেত্রে শরী‘আতসম্মত। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কবর যিয়ারত করেন।
তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আমরা বের হলাম, তিনি তখন উহুদ শহীদগণের কবরস্থান অভিমুখী হন। যখন আমরা হাররা ওয়াকিম দেখতে পেলাম এবং তাঁর নিকট হলাম, তখন দেখা গেল সেখানে বেশ কিছু কবর। তিনি বললেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এগুলো কি আমাদের ভাইগণের কবর? তিনি বলেন: “আমাদের সঙ্গীদের কবর।” অতঃপর যখন (উহুদ) শহীদগণের কবরের নিকট আসলাম, তিনি বললেন: “এ কবরগুলো আমাদের ভাইদের।”[3]
এ কবরস্থানের জন্য কোনো নির্ধারিত দো‘আ নেই। অবশ্য সেই দো‘আই করবে যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। যখন তারা কবরস্থান যিয়ারত করতেন তখন বলতেন:
«السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَاحِقُونَ، يرحم الله المستقدمين منكم والمستأخرين، نسأل الله لنا ولكم العافية»
“হে মুমিন কবরবাসীগণ আপনাদের প্রতি সালাম, নিশ্চয় আমরাও ইনশাআল্লাহ আপনাদের সাথে মিলিত হব। আপনারা যারা অগ্রগামী হয়েছেন ও যারা পরবর্তীতে আসবে, আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন! আমরা আমাদের ও আপনাদের জন্য নিরাপত্তা চাই।”[4]
পক্ষান্তরে মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েয নেই, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«لعن الله زوارات القبور».
“‘আল্লাহ বেশি বেশি কবর যিয়ারতকারীনিদের প্রতি লা‘নত করেন।”[5]
তৃতীয়ত: উহুদের পাদদেশে যে সব শহীদকে দাফন করা হয়
জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে প্রত্যেক দু’জনকে এক কাপড়ে জমা করেন ও বলেন: “তাদের মধ্যে কুরআন কার বেশি মুখস্ত আছে? যখন তাদের উভয়ের মধ্যে কারো প্রতি ইঙ্গিত করা হত, তিনি তাকে কবরে আগে রাখতেন এবং বলতেন আমি তাদের ওপর সাক্ষী রইলাম।” আর তিনি জানাযা ও গোসল না দিয়েই তাদেরকে তাদের রক্তমাখা অবস্থায় দাফন করার হুকুম দেন।
উহুদে দাফনকৃত শহীদগণের উল্লেখযোগ্য:
হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, মুস‘আব ইবন উমাইর, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন হারাম, আমর ইবন জামূহ, সা‘দ ইবন রাবী‘, খারেজা ইবন যায়েদ, নু‘মান ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ।[6]
ইবন নাজ্জার বলেন: “বর্তমানে শহীদগণের কবরগুলোর মধ্যে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবর ব্যতীত কারো কবর চেনা যায় না….। সেখানে অবশিষ্ট কবরগুলোর জন্য কিছু পাথর স্থাপন করা আছে, যাতে বলা হয় যে, সেগুলো তাদের কবর…।”[7]
ইমাম ত্বাবারী বলেন: “উহুদ পাহাড়ের কিবলামুখী শহীদগণের কবর রয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নিহত হন। তাদের মধ্যে হামযা ও তার ভাগ্নে আব্দুল্লাহ ইবন জাহাশের কবর ব্যতীত কারো কবর জ্ঞাত নয়। হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত বরণের স্থানের উত্তরে বেশ কিছু পাথর রয়েছে, সে সম্পর্কে বলা হয়, তা হলো শহীদগণের কবর। অনুরূপ তার শাহাদাতের স্থানের পশ্চিম পার্শ্বেও বেশ কিছু পাথর রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও বলা হয়ে থাকে যে, সেগুলোও শহীদগণের কবর; কিন্তু তা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয় নি। কোনো কোনো “আল-মাগাযী” গ্রন্থে রয়েছে, এ কবরগুলো ঐ সমস্ত লোকেরা যারা নিহত হয়েছে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে রামাদার বছর।[8]
চতুর্থ: এখানে সংঘটিত কতিপয় সুন্নাত পরিপন্থী বিষয় যাতে পতিত হওয়া থেকে সতর্ক হওয়া জরুরি:
যিয়ারতকারীর জন্য যিয়ারতের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত পদ্ধতি নিশ্চিত হওয়া এবং সুন্নাত পরিপন্থী বিষয়ে পতিত হওয়া থেকে সতর্ক হওয়া জরুরি, যা তাকে গুনাহে পতিত করে ছাড়বে বা তার সওয়াব কমিয়ে দেবে। নিম্নে এমন কতিপয় সুন্নাত পরিপন্থী বিষয় উল্লেখ করা হলো যাতে কোনো কোনো যিয়ারতকারী পতিত হয়ে থাকে, যেন যিয়ারতকারীগণ তাতে পতিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারে:
১. উহুদের শহীদগণের কবর যিয়ারতের জন্য বৃহস্পতিবারকে নির্ধারণ করে নেওয়া।
২. উহুদের শহীদগণকে আহ্বান করা, বিশেষ করে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। অনুরূপ তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, সাহায্য কামনা করা ও তাদের জন্য মানত করা।
৩. হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু বা অন্যান্য উহুদের শহীদগণের কবর যিয়ারতের জন্য কিছু কিছু দো‘আ নির্ধারণ করে নেওয়া।
৪. যিয়ারতকারীর মাথা নিচু করে উভয় হাত বুকে বা নাভীর নিচে বেঁধে সালাতে দাঁড়ানোর মতো দণ্ডায়মান হয়ে অবস্থান করা।
৫. কবরস্থান বা পার্শ্ববর্তী চত্তরে শস্য দানা, খাদ্যদ্রব্য বা টাকা-পয়সা নিক্ষেপ করা।
৬. নারী-পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ, যার ফলে সাধারণত ফিতনা সংঘটিতও হয়ে থাকে।
৭. নারীদের কবর যিয়ারত করা।
৮. কবরস্থানের জানালার গ্রীলে নেকড়া-সুতা বাঁধা।
৯. শহীদগণের কবরে বিলাপ ও কান্না-কাটি করা।
১০. যিয়ারতকারীর পক্ষ থেকে ‘রূমাহ’ পাহাড়ে আরোহণ করে বরকত গ্রহণ, এমন বিশ্বাস করে যে এখানে কতিপয় সাহাবীর পদচারণা হয়েছে।
১১. “রূমাহ” পাহাড়ের পাথর দ্বারা বরকত গ্রহণ ও তার দিকে ফিরে সালাত আদায় ও তার উপর সাজদাহ করা।
১২. উহুদ পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হওয়া, সেখানে গিয়ে নেকড়া-সুতা বাঁধা এবং আল্লাহ যে সব দো‘আর অনুমতি দেন নি এমন এমন দো‘আয় সচেষ্ট হওয়া।
১৩. কোনো কোনো স্থান যিয়ারত করা এমন বিশ্বাস করে যে, সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিহ্ন রয়েছে। যেমন, কোন পাথরে।
সমাপ্ত
………………………………………………………………………………………..
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৬৫
[2] দেখুন: মু‘জামুল বুলদান: ১/১০৯ ইত্যাদি গ্রন্থ।
[3] মুসনাদে ইমাম আহমাদ: ১/১৬১, আবু দাঊদ, হাদীস নং ২০৪৩
[4] সহীহ মুসলিম,হাদীস নং ৯৭৪
[5] তিরমিযী, হাদীস নং ৩/৩৭২
[6] ওয়াকেদী রচিত আল-মাগাযী: ১/৩১০
[7] দেখুন: আদ- দুররাতুস সামীন, পৃ: ৯৮-৯৯
[8] দেখুন: আত-তা‘রীফ: ১২৫-১২৬
Source: www.quraneralo.com