১. العلم إن طلبته كثير والعمر عن تحصيله قصير فقدمِ الأهم منه فالأهم ‘জ্ঞানার্জনের বিষয়বস্ত্ত অসীম। কিন্তু মানুষের বয়স সসীম। তাই জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেই অগ্রাধিকার দাও’।
২. الحق ثقيل فلا نثقله بأسلبونا ‘হক স্বভাবতই ভারী। সুতরাং আমরা আমাদের পদ্ধতি দ্বারা (দাওয়াতী ময়দানে কঠোরতা অবলম্বন করে) তাকে আরো ভারী করতে পারি না’।
৩. خير الأمور الوسط، وحب التناهي غلط ‘সর্বাধিক কল্যাণকর হ’ল মধ্যপন্থা অবলম্বন। চরমপন্থার প্রতি আকর্ষণটা ভূল।
৪. العلم لا يقبل الجمود ‘জ্ঞান কখনও স্থবিরতাকে গ্রহণ করে না’ (কেননা তা গতিশীল)।
৫.طالب الحق يكفيه دليل واحد، و صاحب الهوى لا يكفيه ألف دليل، الجاهل يُعلّم، وصاحب الهوى ليس لنا عليه سبيل. ‘সত্যাসন্ধানীর জন্য একটি দলীলই যথেষ্ট। আর প্রবৃত্তিপূজারীর জন্য হাযার দলীলও কাজে আসে না। অজ্ঞ ব্যক্তিকে শিক্ষাদান করা যায়। কিন্তু প্রবৃত্তিপূজারীর জন্য আমাদের কিছু করার নেই’।
৭.طريق الله طويل.. ونحن نمضي فيه كالسلحفاة.. وليس الغاية أن نصل لنهاية الطريق.. ولكن الغاية أن نموت علي الطريق..
‘আল্লাহর পথ সুদীর্ঘ। আমরা সেখানে কচ্ছপের ন্যায় পরিভ্রমণ করছি। পথের শেষ সীমায় পৌঁছতে হবে এটা আমাদের লক্ষ্য নয়; বরং মৃত্যু অবধি পথের উপর টিকে থাকাই আমাদের লক্ষ্য’।
৮. শায়খ আলবানীর গাড়িটি ছিল তাঁর দ্বীনী ভাইদেরও বাহন। তিনি এই গাড়িতে করে বন্ধুদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া বা নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতেন। এর কারণ সম্পর্কে একদিন তিনি তাঁর সাথীকে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আমার পিতা বলতেন, لكل شيء زكاة، وزكاة السيارة حمل الناس بها ‘প্রত্যেক বস্ত্তর যাকাত রয়েছে। আর গাড়ির যাকাত হ’ল মানুষকে বহন করা’।
৯. দাওয়াতী নীতি প্রসঙ্গে :
(ক) আমাদের দাওয়াত ৩টি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) কুরআন (২) হাদীছ (৩) সালাফে ছালেহীনের অনুসরণ। যে ব্যক্তি মনে করবে যে, সে কেবল কুরআন ও হাদীছের অনুসরণ করবে। কিন্তু সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুসরণ করবে না এবং বলবে যে, তাঁরাও মানুষ আমরাও মানুষ (তাই তাদের অনুসরণের প্রয়োজন নেই); সে গোমরাহীতে নিপতিত হবে।
(খ) সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা অনুযায়ী আমরা মানুষের উপর কোন শারঈ আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছেন, ‘তুমি তাদের উপর দারোগারূপে প্রেরিত হওনি’ (গাশিয়া ৮৮/২২)। সুতরাং আমরাও মানুষের উপর দারোগার ভূমিকায় অবতীর্ণ হ’তে পারি না। বরং আমরা সকলকে সেই বাক্যটিই বলতে চাই, ألْقِ كلمتَك وأَمشِ ‘তুমি তোমার বক্তব্য পেশ কর, অতঃপর চলে যাও’। তোমার মত অনুযায়ী পরিচালনার জন্য মানুষের উপর তরবারি দিয়ে ক্ষমতা বিস্তার করার অধিকার তোমার নেই। কারণ হক-এর নীতি হ’ল, الحق أبلج والباطل لَجْلَج ‘হক সর্বদা সুস্পষ্ট আর বাতিল অস্পষ্ট ও বক্রতাপূর্ণ’। আর সুনিশ্চিতভাবেই একথাটি দুনিয়ার সর্বাধিক সত্য বাক্য لا إله إلا الله -এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(গ) দাঈকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যখন সে বুঝবে যে, তার প্রতিপক্ষ স্বীয় মতের উপর এমনই কঠোর, যে তার সাথে বিতর্কে যেয়ে কোন লাভ নেই এবং যদি সে ধৈর্য নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে যেতে থাকে, তবে হয়ত অনাকাংখিত কিছু ঘটে যাবে, তখন বিতর্ক পরিত্যাগ করাই তার জন্য উত্তম হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া পরিত্যাগ করে, আমি জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহের যিম্মাদার হব’ (আবূদাঊদ হা/৪৮০০)।
(ঘ) রাসূল (ছাঃ) বলেন, إن بني إسرائيل لما هلكوا قصوا ‘নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলগণ কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনায় লিপ্ত হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়েছিল’ (ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/১৬৮১)। এ হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ আলবানী বলেন, সম্ভবত এটা এ কারণে বলা হয়েছে যে, তাদের আলেম ও বক্তাগণ জনগণকে ফিকহ এবং উপকারী জ্ঞানের পরিবর্তে অলীক কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনাকে গুরুত্ব দিয়েছিল এবং এই কাজকেই নেকআমল গণ্য করা শুরু করেছিল। ফলে তারা ধ্বংসে নিপতিত হয়েছিল। আজকের যুগের বহু গল্পকার বক্তাদেরও একই অবস্থা। যাদের অধিকাংশ বক্তব্যের বিষয়বস্ত্ত হ’ল ইসরাঈলী গাল-গল্প, হৃদয় গলানো বক্তব্যসমূহ এবং ছূফী ধ্যানধারণাভিত্তিক অলীক কাহিনী।
১০. ইসলামী খেলাফত প্রসঙ্গে :
بدونهاةين المقدّمةين: العلم الصحيح، والةربية الصحيحة على هذا العلمالصحيح يستحيل – في اعتقادي – أن تقوم قائمة الإسلام، أو حكم الإسلام، أودولة الإسلام-
(ক) ‘আমার মতে, প্রাথমিক দু’টি বিষয় অর্থাৎ শরী‘আতের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন এবং উক্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক প্রশিক্ষণ ব্যতীত ইসলামের প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিংবা ইসলামী শাসন বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব’ (আলবানী, আত-তাছফিয়াহ ওয়াত তারবিয়াহ পৃঃ ৩১)।
(খ) আধুনিক যুগের একজন প্রখ্যাত দাঈ শায়খ হাসানুল বান্নার পরে যিনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের মুর্শিদে ‘আম কাযী হাসান হুযায়মী (১৮৯১-১৯৭৩ইং)-এর একটি মন্তব্য শায়খ আলবানী খুবই পসন্দ করেছিলেন। তার বিভিন্ন গ্রন্থে উক্তিটি লক্ষ্য করা যায়। সেটি হ’ল- أقيموا دولة الإسلام في قلوبكم، تقم لكم في أرضكم- ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে প্রথম ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’। তিনি বলেন, ‘এটি খুবই সুন্দর একটি মন্তব্য। আর তদনুযায়ী কাজ করা তার চেয়ে আরো সুন্দর’ (সিলসিলা যঈফাহ, মুকাদ্দামা)। শায়খ আলবানী তাঁর এই বক্তব্যকে অন্য স্থানে ‘এটা যেন আসমানী অহী-র ন্যায় যথার্থ’ বলে মন্তব্য করেছেন (আত-তাছফিয়াহ ওয়াত তারবিয়াহ পৃঃ ৩৩)।
(গ)رأينا في هذا الزمان أن من السياسة ةرك السياسة ‘আমি মনে করি এ যুগে (প্রচলিত) রাজনীতি পরিত্যাগ করাই হ’ল রাজনীতি’।
১১. আদব-আখলাক প্রসঙ্গে :
(ক)كنت أظن بأن مشكلة المسلمين عقائدية فقط، فتبين لي فيما بعد بأنها أخلاقية أيضا ‘আমি ধারণা করতাম মুসলমানদের সমস্যা কেবলমাত্র আক্বীদাগত। কিন্তু এখন আমার কাছে স্পষ্ট যে, এর সাথে নৈতিক বা চারিত্রিক সমস্যাও একটি বড় সমস্যা’।
(খ) শেষ যামানার আমাদের মুসলমানদের মাঝে যদিও ইলমী জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে; কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, এর সাথে নৈতিক ও চারিত্রিক জাগরণ সৃষ্টি হচ্ছে না। আমাকে দোষারোপ করো না যদি তোমাদের বলি যে, এই মজলিসে তোমরা যখন প্রবেশ করছিলে তখন খুব হুড়োহুড়ি ও গোলযোগ সৃষ্টি করছিলে। আমি তোমাদের বলব, এটা ইসলামী চরিত্র নয়। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য অপরিহার্য যে, ইলমী জাগরণের সাথে সাথে আমাদের চারিত্রিক দিকটিতেও যেন জাগরণ পরিলক্ষিত হয়।
(গ) একদিন আলবানী সালাফী দাওয়াতের ক্ষেত্রে কিছু রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আমাদের মাঝে কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা আক্বীদাগত দিক থেকে সালাফী মানহাজকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে চারিত্রিক দিক দিয়ে তারা মোটেও সালাফী নন।
১২. গণতন্ত্র প্রসঙ্গে :
فالديمقراطية والإسلام نقيضان لا يجتمعان، إما الإيمان بالله والحكم بما أنزل الله، وإما الإيمان بالطاغوت والحكم به وكل ما خالف شرع الله فهو طاغوت.. (مجلة الأصالة، العدد ٢ ص : 24)
(ক) ইসলাম ও গণতন্ত্র দুটো বিপরীতমূখী ব্যবস্থা। যা কখনো একত্রিত হ’তে পারে না। একটি হ’ল আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও তিনি যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী শাসন করা। অপরটি হ’ল ত্বাগূতের উপর বিশ্বাস ও তদনুযায়ী শাসন করা। আর যেটাই আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী, সেটাই ত্বাগূত।
لو كانت الديمقراطية تعني معنى إسلاميًا صرفًا لا غبار ولا شائبة عليه نحن لا نجيز أن نسمي معنى شرعيا بلفظ كافر أجنبي–
(খ) আর গণতন্ত্র যদি কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ না রেখে খালেছ ইসলামী অর্থও বহন করত, তবুও একটি অপরিচিত কুফরী অর্থবোধক শব্দকে শারঈ অর্থে নামকরণ করা আমরা সিদ্ধ বলতাম না।
১৩. চরমপন্থী খারেজীদের উদ্দেশ্যে :
(ক) কিভাবে তোমরা ইলাহী শরী‘আত বাস্তবায়নের আহবান জানাচ্ছ, অথচ প্রথমে তোমরা নিজেরাই আল্লাহর হুকুম লংঘন করছ? কিভাবে তোমরা ভ্রষ্টতা, প্রবৃত্তিপরায়ণতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষগুলোর উপর ইসলামী শরী‘আত বাস্তবায়ন করবে? মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আনীত দ্বীন ইসলামের বাস্তবতা সম্পর্কেই তো তারা অজ্ঞতায় ঢাকা পড়ে রয়েছে। আল্লাহ তোমাদের কাছে যা চেয়েছেন তা হ’ল, তোমরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক জীবনে ইসলামের হুকুম জারী কর।
১৪. কম্পিউটার প্রসঙ্গে :
(ক)الكمبوتر يجعل طالب العلم بليدا ‘কম্পিউটার জ্ঞান অন্বেষণকারীকে অলস বানিয়ে দেয়’।
(খ) শেষ জীবনে আলবানী কম্পিউটার সম্পর্কে তাঁর মতামত পরিবর্তন করেছিলেন। যেমন জনৈক ব্যক্তি তাকে ইলমে হাদীছে কম্পিউটারের ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি মনে করি ব্যবহারকারী যদি হাদীছ শাস্ত্রের একজন আলেম হন, তাহ’লে তার জন্য কম্পিউটার আধুনিক যুগে মুসলিম উম্মাহর নিকটে হাদীছে নববীকে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হবে। আর ব্যবহারকারী যদি হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ হন, তাহ’লে সেটা হবে অন্ধকার রাতে দিশাহীন পথিকের মত। তাদের অবস্থা হবে ঐসব (অযোগ্য) লোকের মত যারা ইদানীংকালে হাদীছশাস্ত্র নিয়ে লিখছে এবং তাদের জন্য ঐ প্রবাদ বাক্যটি প্রযোজ্য হবে যেটি আমি প্রায়ই বলে থাকি, أنه تزبب قبل أن يتحصرم অর্থাৎ ‘আঙ্গুর পাকার আগেই সে কিসমিস হয়ে গেছে’ (অর্থাৎ কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পূর্বেই যোগ্যতা হাছিলের দাবী করা। বাংলায় যাকে বলে ‘ইঁচড়ে পাকা’)।
১৫. ওলামায়ে কেরামের প্রতি সম্মান :
(ক) শায়খ আহমাদ সালেক শানক্বীত্বী (১৯২৮-২০১০ইং)-কে শায়খ আলবানী খুবই সম্মান করতেন। তাঁর কাছে কোন ফৎওয়া আসলে কোন কোন সময় তিনি শায়খ শানক্বীত্বীর কাছে জিজ্ঞেস করতেন। একবার তিনি বলছিলেন, أشتري مجالسة السالك بالذهب ‘আমি সালেকের সাথে বসাকে স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রয় করব’। এছাড়াও তিনি তাঁকে জর্দানের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ফকীহ বলে আখ্যায়িত করতেন।
(খ) তাঁর ছাত্র ইছাম হাদী বলেন, আমি একদিন শায়খ আলবানীকে শায়খ আরনাউত্বের নাম উচ্চারণ না করে তাকে সর্বদা ‘الإحسان في تقرير صحيح ابن حبان -এর তা‘লীক প্রদানকারী’ বলার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি শায়খ শু‘আইব আরনাউত্ব সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করি তাতে তিনি এরূপ ভুল করতে পারেন না। আমার বিশ্বাস এটা তাঁর অধীনে যারা কাজ করে তাদের ভুল। তবে যখনই আমার ধারণা হবে যে, এটা শু‘আইব আরনাউত্বেরই ভুল, কেবল তখনই আমাকে তাঁর নাম উল্লেখ করতে দেখবে।
১৬. ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক :
(ক) শায়খ আলবানী স্বীয় ছাত্রদেরকে খুবই ভালোবাসতেন। তাদেরকে সবসময় إخواني বা ‘আমার ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন। ইছাম হাদী বলেন, আমাকে তিনি বহুদিন বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ما رأيك يا أسةاذ في هذه المسألة ‘হে উস্তায! এই মাসআলায় তোমার মত কি?’
(খ) তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র শায়খ মাশহূর হাসান সম্পর্কে সিলসিলা ছহীহাহর ৫০০ নং হাদীছে একটি বিষয় উল্লেখ করার পর বলেছেন, আমি এ বিষয়টি গ্রহণ করেছি বিশিষ্ট ভাই মশহূর হাসান কৃত خلافيات للبيهقي গ্রন্থের তাহকীক থেকে। আল্লাহ তাকে উক্ত তাখরীজ কর্মটি পূর্ণভাবে সম্পন্ন করার তাওফীক দান করুন এবং পাঠকদের জন্য উপকারী করে দিন’। এছাড়া তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন স্থানে তার ছাত্রসহ অনেক আলেমের নাম উল্লেখ করে তাদের জন্য দো‘আ করেছেন, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ভুল সংশোধন করে দিয়েছেন।
(গ) ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল তা তাঁর বক্তব্যে ফুটে ওঠে। তিনি একবার বলেছিলেন,بلغ من تعلق الطلاب بي أنني عندما أذهب إلي سيارتي أجدها ممتلئة بالطلاب ‘ছাত্রদের সাথে আমার সম্পর্ক এমন হয়ে গিয়েছিল যে, আমি যখনই আমার গাড়ির নিকটে যেতাম, তখনই তাকে আমি ছাত্রদের দ্বারা পূর্ণ পেতাম’।
১৭. শত্রুদের সম্পর্কে :
জনৈক ছাত্র আলবানীকে বলেন, আমাদের একজন আপনার প্রতি শত্রুতা পোষণ করে এবং আপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বলে থাকে। আমরা কি তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করব?
আলবানী বললেন, সে কি ব্যক্তি আলবানীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, নাকি আলবানীর কিতাব ও ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক অনুসৃত আক্বীদা ও দাওয়াতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে?
যদি সে কিতাব ও সুন্নাহর আক্বীদার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তাহ’লে তার সাথে আলবানীর আলোচনা করতে হবে এবং ধৈর্যধারণ করতে হবে। এরপরও যদি সে সংশোধন না হয় এবং তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করাই কল্যাণকর বিবেচিত হয়, তাহ’লে তাই করতে হবে। আর যদি ব্যক্তি আলবানীর প্রতি সে শত্রুতা রাখে কিন্তু আমাদের কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক আক্বীদার সাথে একমত থাকে, তাহ’লে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা যাবে না।
১৮. বিনয় প্রকাশ :
(ক) আলবানী অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহংকার ছিলেন। ইছাম হাদী বলেন, আমি কখনোই তাকে কোন প্রশংসাকারীর প্রশংসায় মুগ্ধ হ’তে দেখিনি। যদি তিনি কখনো প্রশংসা শুনতে বাধ্য হ’তেন, তখন তিনি দো‘আ করতেন, اللهم لا تؤاخذني بما يقولون واجعلني خيرا مما يظنون واغفرلي ما لا يعلمون- ‘হে আল্লাহ! তারা যা বলছে, সেজন্য আমাকে পাকড়াও করো না। তারা যা ধারণা করে তা থেকে আমাকে উত্তম করো এবং আমার যে দোষ-ত্রুটি তারা জানে না তা ক্ষমা করে দাও’। এসময় তাঁর দু’গন্ড বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে দেখা যেত।
(খ) তিনি প্রায়ই বলতেন, أنا طُوَيْلِبُ العلم ‘আমি নগণ্য জ্ঞানান্বেষী মাত্র’। তাঁর ঘনিষ্ট ছাত্র ইছাম হাদী একদিন তাকে বললেন, আপনি যদি নিজেকে নগণ্য জ্ঞান না করে কেবল طالب علم বা ‘জ্ঞানান্বেষী’ বলতেন, তাহ’লে আমাদের মত ছাত্ররা নিজেদেরকে طويلب العلم বলতে পারতাম! আলবানী হেসে ফেললেন এবং পুনরায় বললেন, না আমি طويلب العلم বা ‘নগণ্য জ্ঞানান্বেষী’।
(গ) ইছাম হাদী বলেন, একদিন আমি তাকে একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এটা আমার জানা নেই। আগামীকাল আমাকে জিজ্ঞেস করো। হয়তো আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে আমার সামনে কিছু উদ্ভাসিত করবেন। কিন্তু পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহ আমার সামনে এ ব্যাপারে কিছুই খুলে দেননি।
১৯. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে :
আল-বায়ান পত্রিকার সম্পাদক এক সাক্ষাৎকারে শায়খ আলবানীকে জিজ্ঞেস করেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু মানুষ সমালোচনা করে এবং অভিযোগ করে যে সেখান থেকে বিজ্ঞ আলেম বের হচ্ছে না। আপনার মতে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি কি?
উত্তরে তিনি বলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই আলেম বের করার ক্ষমতা রাখে না। বরং ছাত্রদেরকে আলেম হওয়ার জন্য ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে দেয় মাত্র। এটা সত্য যে, যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারেগ হচ্ছে তারা পরবর্তীতে নিজ নিজ কর্তব্যের উপর দৃঢ় থাকতে পারছে না। তারা জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য যেসব নিয়ম-পদ্ধতি ও দিক-নির্দেশনা তাদের শিক্ষকদের থেকে অর্জন করেছে তদনুসারে কাজ করছে না। সেইসাথে লেখনী, বক্তব্য ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের পরিপক্কতা লাভের চেষ্টাও তাদের মধ্যে নেই। বরং অধিকাংশের লক্ষ্যবস্ত্ত হয়ে যাচ্ছে কোথাও শিক্ষক হওয়া অথবা কোন দেশে গিয়ে বড় চাকুরীতে যোগদান করা। আসলে আজ মুসলিম আলেমদের সবচেয়ে বড় মুছীবত হ’ল তাদের মধ্য থেকে তাক্বওয়া এবং জ্ঞানের চর্চা হারিয়ে যাওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন করে বসে থাকলে তা যথেষ্ট হয় না, বরং তা জ্ঞানার্জনকারীর জন্য ক্ষতিই বয়ে আনে (মাজাল্লাতুল বায়ান, ৩৩ তম সংখ্যা, রবীউল আখের ১৪১১ হিঃ)।
২০. তাখরীজ প্রসঙ্গে :
জনৈক ব্যক্তি শায়খ আলবানীকে তাখরীজের ক্ষেত্রে তাঁর যে সব ভুল হয়েছে এবং পরবর্তীতে সংশোধন করেছেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। উত্তরে তিনি বললেন, যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে, আলবানী কি তার কোন কিতাবে ভুল করেছেন এবং পরে তা শুদ্ধ করেছেন? তাহ’লে আমি স্বীকার করব যে, সেখানে আমি কিছু ভুল করেছিলাম। পরে তা শুদ্ধ করে দিয়েছি। যেমন ইমাম শাফেঈ বলেছেন, أبي الله أن يتم إلا كتابه، بس كتاب الله هو التمام- ‘আল্লাহ তাঁর নিজের কিতাব ব্যতীত অন্য কোন কিতাব পূর্ণাঙ্গ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাবই পূর্ণাঙ্গ’।
২১. জামা‘আত প্রসঙ্গে :
জনৈক ব্যক্তিকে আলবানী বললেন, তুমি কোন জামা‘আতভুক্ত? লোকটি বলল, আমি কোন ফেরকাবাজি করি না। শায়খ বললেন, ফেরকাবাজি এবং জামা‘আত দু’টি ভিন্ন জিনিস। একটির সাথে অপরটির কোন সম্পর্ক নেই।
২২. নিজেকে সালাফী বলে পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে :
পরবর্তী যুগের মানুষ হিসাবে অবশ্যই আমাদেরকে কুরআন, হাদীছ এবং পূর্ববর্তী মুমিন বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। আমাদের জন্য একথা বলা জায়েয হবে না যে, আমরা সালাফে ছালেহীনের মাসলাক অনুসরণ ব্যতীতই কুরআন ও হাদীছকে বুঝে অনুসরণ করব। এ যুগে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নিসবত গ্রহণ করা ব্যতীত উপায় নেই। আমাদের এটা বলা যথেষ্ট হবে না যে, আমি একজন মুসলিম অথবা ‘আমার মাযহাব ইসলাম’। কারণ রাফেযী, ইবাযী, কাদিয়ানী সকল ফেরকাই একথা বলে থাকে। কিসে তাদের থেকে তোমাকে পার্থক্য করবে?
যদি তুমি বল, ‘আমি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম’। এটাও যথেষ্ট নয়। কারণ বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী, আশ‘আরী, মাতুরীদী সকলেই একই দাবী করে থাকে।
নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পষ্ট ও বৈশিষ্টমন্ডিত নামকরণ হবে এই যে, তুমি বলবে আমি কুরআন, হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের অনুসারী। যেটা সংক্ষেপে তুমি বলবে, ‘আমি একজন সালাফী’। এক্ষেত্রে তিনি একটি চমৎকার পংক্তি উল্লেখ করতেন তা হ’ল-
وكل خير في اتباع من سلف + وكل شر في ابتداع من خلف
অর্থাৎ ‘সালাফে ছালেহীনের অনুসরণেই সকল কল্যাণ। পরবর্তীদের সৃষ্ট বিদ‘আতের মধ্যেই সকল অকল্যাণ’।
তারপর তিনি সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তর্কের খাতিরে যদি আমরা কেবল ‘মুসলিম’ হিসাবেই নিজেদের নামকরণ করি; যদিও ‘সালাফী’ সম্বন্ধটি একটি সঠিক এবং মর্যাদাপূর্ণ নাম। তাহ’লে তারা কি নিজেদের দল, মাযহাব বা তরীকার নামকরণ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন? যে সকল নাম আদতেই শরীআতসম্মত নয়?
এরপর তিনি বলেন,
فحسبكم هذا التفاوتُ بيننا + وكلُّ إناءٍ بما فيه ينضَحُ
তোমাদের সাথে আমাদের মধ্যকার এই পার্থক্যই যথেষ্ট। প্রত্যেক পাত্র তাই-ই নিঃসরণ করে, যা তার মধ্যে থাকে’।
২৩. আহলেহাদীছ প্রসঙ্গে :
(ক) একবার পাকিস্তানের আহলেহাদীছগণ একটি দাওয়াতী সম্মেলনে শায়খ আলবানীকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তিনি তাতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হ’লেন না। তখন তারা তাঁর ছাত্র শায়খ হাশেমীকে অনুরোধ করলেন শায়খ আলবানীর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু শায়খ আলবানী আবারও ওযর পেশ করে বললেন যে, তার না যাওয়ার কারণ হ’ল, পাকিস্তানের আহলেহাদীছ ভাইয়েরা তার প্রতি ভালোবাসায় বাড়াবাড়ি করছেন। অতঃপর শায়খ হাশেমী যখন তাঁকে সেখানকার কিছু আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন আলবানী শায়খ হাসান বিন মুহাম্মাদের চরণটি আবৃত্তি করলেন,
أَهْلُ الْحَدِيْثِ هُمْ أَهْلُ النَّبِيْ + وَإِنْ لَمْ يَصْحَبُوْا نَفْسَهْ أَنْفَاسُهُ صَحِبُوْا
অর্থাৎ ‘আহলেহাদীছগণ তো নবী করীম (ছাঃ)-এর পরিবার।
যদি তারা স্বয়ং সাথী নাও হন, তবুও তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস তাদের সাথী’।
অতঃপর বললেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। তিনি যেন আমাকে কিয়ামতের দিন তাদের সাথেই পুনরুত্থিত করেন। একথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ, পৃঃ ১৩৮)।
(খ) শায়খ আলবানী তাঁর বিখ্যাত ‘সিলসিলা ছহীহাহ’ গ্রন্থের ২৭০ নং হাদীছে ফেরক্বা নাজিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে আহলেহাদীছগণ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের ও আইম্মায়ে এযামের মন্তব্য তুলে ধরার পর বলেন, ইমামগণ আহলেহাদীছদেরকে নাজী ফেরক্বা ও বিজয়ী দল হিসাবে চিহ্নিত করায় কিছু মানুষ বিব্রত বোধ করে থাকে। মূলতঃ এটা অস্বাভাবিক মনে করার কোন কারণ থাকবে না যদি নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আমরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেই।
প্রথমতঃ আহলেহাদীছগণ হাদীছ গবেষণা ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলী যেমন রাবীদের জীবনী, হাদীছের দোষ-ত্রুটি ও তার বিভিন্ন সূত্র সম্পর্কে পান্ডিত্য হাছিলের দিক থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত, তার পথনির্দেশ, তাঁর চরিত্র, যুদ্ধাভিযান ও ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞান রাখে।
দ্বিতীয়তঃ মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন ফেরক্বা ও মাযহাবে বিভক্ত হয়েছে যা ১ম শতাব্দীতে ছিল না।[৮] আর প্রত্যেক মাযহাবেরই নিজস্ব মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা রয়েছে। রয়েছে এমন হাদীছসমূহ, যা থেকে তারা দলীল পেশ করেন ও যার উপর তারা নির্ভর করেন। এসব মাযহাবের মধ্যে কোন একটিকে অনুসরণকারী মুকাল্লিদ কেবল সেই মাযহাবেরই অন্ধ অনুসরণ করে এবং সে মাযহাবের সকল সিদ্ধান্তকে অাঁকড়ে থাকে। ঐ ব্যক্তি অন্য মাযহাবের দিকে ভ্রূক্ষেপও করে না। অথচ হয়তবা সেখানে সে এমন হাদীছ খুঁজে পেত, যা তার অনুসৃত মাযহাবে পায়নি। বিদ্বানদের এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে, প্রত্যেক মাযহাবেই এমন অনেক সুন্নাত ও হাদীছ রয়েছে যা অন্য মাযহাবে পাওয়া যায় না। ফলে সুনির্দিষ্ট একটি মাযহাবের অনুসারী ব্যক্তি অন্য মাযহাবসমূহে সংরক্ষিত বিপুলসংখ্যক হাদীছের প্রতি আমল করা থেকে বিস্মৃত থেকে যায়। কিন্তু আহলেহাদীছগণ এর ব্যতিক্রম। কেননা তারা বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত সকল হাদীছই গ্রহণ করে থাকেন, তা সে যে মাযহাবের হৌক না কেন। তার বর্ণনাকারী যে দলেরই হৌক না কেন, যতক্ষণ তিনি বিশ্বস্ত মুসলিম হন। এমনকি বর্ণনাকারী হানাফী, মালেকী বা অন্য মাযহাব দূরে থাক, যদি শী‘আ, ক্বাদারী, খারেজীও হন, তবুও সে হাদীছ তারা গ্রহণ করেন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এটাই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি ইমাম আহমাদ-কে লক্ষ্য করে বলেন, أنتم أعلم بالحديث مني، فإذا جاءكم الحديث صحيحا فأخبرني به حتى أذهب إليه سواء كان حجازيا أم كوفيا أم مصريا ‘আপনি হাদীছ সম্পর্কে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। অতএব যখনই আপনার নিকটে কোন ছহীহ হাদীছ পৌঁছবে, তখনই আপনি আমাকে তা অবহিত করবেন। যাতে আমি সেদিকে যেতে পারি। হৌক বর্ণনাকারী হেজাযী, কূফী কিংবা মিসরী।’ কিন্তু আহলেহাদীছগণ- আল্লাহ আমাদেরকে হাশরের ময়দানে তাদের সাথে সমাবেত করুন- তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কারু বক্তব্যের অন্ধ অনুসরণ করে না, যতই শ্রেষ্ঠ বা মহান ব্যক্তি হৌক না কেন। অথচ অন্যেরা যারা হাদীছ ও তার উপর আমলের প্রতি সম্বন্ধ করে না, তারা ইমামগণের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও স্ব স্ব ইমামের বক্তব্যের অন্ধ অনুসরণ করে থাকে। যেমনভাবে আহলেহাদীছগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসরণ করে থাকে। উপরোক্ত আলোচনার পর এতে কোন বিস্ময়ের অবকাশ থাকে না যে, আহলেহাদীছগণই বিজয়ী দল এবং নাজী ফেরক্বা। বরং তারাই হ’ল সেই মধ্যপন্থী উম্মত যারা (কিয়ামতের দিন) সমগ্র সৃষ্টির উপর সাক্ষী হবেন।
আহলেহাদীছগণের বিরোধীদের বক্তব্যের জবাবে খতীব বাগদাদী স্বীয় ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ বইয়ের ভূমিকায় যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেছেন,…আল্লাহ তা‘আলা আহলেহাদীছগণকে শরী‘আতের ভিত্তি স্বরূপ করেছেন, তাদের দ্বারাই জঘন্য সব বিদ‘আতকে ধ্বংস করেছেন, তারাই হ’ল সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর দ্বীনের রক্ষক এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর উম্মতের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনকারী। তারাই হ’ল উম্মতের অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামকারী। প্রত্যেক দল স্ব স্ব খেয়াল-খুশীর আশ্রয় নেয় ও সেদিকে ফিরে যায়। তারা যে রায়টি পসন্দ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, আহলেহাদীছগণ ব্যতীত। কেননা কুরআন তাদের হাতিয়ার, হাদীছ তাদের দলীল, স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) তাদের নেতা, তাঁর দিকেই তাদের সম্বন্ধ। তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর উপরে চলে না, কারো রায়ের দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না।…. তারা রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত শরী‘আতকে কথায় ও কাজে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করে। তার সুন্নাতের সংরক্ষণ ও তা মানুষের কাছে বিবৃত করার মাধ্যমে দ্বীনের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে এবং তারা তাকে মৌলিক ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তারাই এর প্রকৃত হকদার ও প্রকৃত অনুসারী। কত দুষ্কৃতিকারী শরী‘আত বহির্ভূত বিষয়কে শরী‘আতের মধ্যে ঢুকানোর চেষ্টা করেছে! কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা আহলেহাদীছদের মাধ্যমে তাদের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছেন। ফলে তারাই শরী‘আতের মৌলিক ভিত্তিসমূহের হেফাযতকারী এবং তার নির্দেশ ও মর্যাদার তত্ত্বাবধানকারী। যখন লোকেরা এর প্রতিরোধে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন এরাই তার পক্ষে ধনুকে তীর সংযোজন করে। এরাই হ’ল আল্লাহর দল। আর নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম’।
অতঃপর আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে তিনি বলেন, ‘পরিশেষে আমি আহলেহাদীছদের জন্য ভারতের একজন বিখ্যাত হানাফী পন্ডিত আবুল হাসানাত মুহাম্মাদ আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী (১২৬৪-১৩০৪ হিঃ) প্রদত্ত সাক্ষ্য তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি ন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখবে এবং খেয়ালখুশীর অনুসরণ না করে ফিক্হ ও উছূলের সমুদ্রে ডুব দিবে, তার মধ্যে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে যে, অধিকাংশ মৌলিক ও শাখাগত মাসআলা, যেগুলি নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে, সেসব ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণের মাযহাবই সকল মাযহাবের চেয়ে শক্তিশালী। যখনই আমি মতবিরোধের গিরিপথে ভ্রমণ করি, মুহাদ্দিছগণের বক্তব্যকে অধিকতর ন্যয়সঙ্গত দেখতে পাই। তাদের প্রতি আল্লাহর কতই না অনুগ্রহ! তাদের প্রতিই আমাদের কৃতজ্ঞতা! আর কেনইবা নয়! তারাই তো রাসূল (ছাঃ)-এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাঁর আনীত শরী‘আতের যথার্থ প্রতিনিধি। আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাদের দলের সাথে পুনরুত্থান ঘটান এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের অনুসৃত পথের উপরেই আমাদের মৃত্যু দান করেন’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর আলোচনা দ্রঃ)।
২৪. সকল কাজে ইখলাছের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে :
মুসলমানদের সকল কাজ ইখলাছপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। কারণ সকল কাজের মূল হলো ইখলাছ। إن كان بخاري زمانه في الحديث وأبو حنيفة في الفقه ولم يخلص في عمله فهذا لن ينفعه بشيئ অর্থাৎ যদি সে হাদীছ শাস্ত্রে ইমাম বুখারীর মত হয় এবং ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফার মত হয়, অথচ তার আমলে ইখলাছ না থাকে, তাহ’লে তার এই খেদমত (তার পরকালের জন্য) কোনই উপকারে আসবে না।
কোন আমলই কবুলযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না তাতে দু’টি শর্ত বিদ্যমান থাকবে। (১) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হ’তে হবে (২) ইখলাছপূর্ণ হ’তে হবে। এ দু’টি শর্তের যেকোন একটি না থাকলে সে আমল আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না।
অতঃপর শায়খ আলবানী ইখলাছবিহীন আমল থেকে বাঁচার জন্য দু’টি পথ দেখিয়েছেন।
(১) খ্যাতির মোহ থেকে মুক্ত থাকা : যে ব্যক্তি আমলকে ইখলাছপূর্ণ করতে চায়, তাকে খ্যাতির প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের প্রশংসা থেকে দূরে থাকতে হবে। এথেকে দূরে থাকতে পারলে অল্প আমলের বিনিময়ে পাহাড়সম নেকী অর্জিত হবে। খ্যাতির প্রতি আকর্ষণ সম্পদের প্রতি আকর্ষণের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর। কেননা এর মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও মৃত্যুকে অপসন্দ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাই প্রত্যেকের জন্য উচিৎ হবে দৃঢ়পদ থাকা এবং মানুষের প্রশংসা এবং তাদের মধ্যে স্বীয় প্রসিদ্ধির কারণে প্রভাবিত না হওয়া।
(২) আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা : প্রত্যেক মুজাহিদ এবং আলেমের জন্য আবশ্যক হ’ল তারা তাদের কার্যক্রমের জন্য কোন প্রতিদান বা শুকরিয়া কামনা করবেন না। এখানে উভয়েই আল্লাহর পথে জিহাদ করছেন। একজন স্বীয় ইলম দ্বারা। অপরজন স্বীয় বীরত্ব, শক্তি এবং সাহসিকতার দ্বারা। তাই এখানে প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহ’লে তার পরিণাম হবে অজ্ঞ ব্যক্তির পরিণামের চেয়েও ভয়াবহ। আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে একটি আছার বর্ণিত হয়েছে, ويل للجاهل مرت وويل للعالم سبع مرات ‘জাহেলের জন্য একগুণ ধ্বংস কিন্তু আলেমের জন্য সাতগুণ ধ্বংস নির্ধারিত’। এখানে সাতগুণ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আলেম ইলম থাকার কারণে অধিক শাস্তির সম্মুখীন হবেন। (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর ১/১৪৯, ২৬০, ২৯১; ইয়াদ মুহাম্মাদ ছালেহ, মানহাজুল আলবানী ১৪১-১৪৩ পৃঃ)
২৫. ফৎওয়া প্রসঙ্গে :
أن الإستعجال في الفتيا من مصائب زماننا ‘তড়িঘড়ি কোন বিষয়ে ফৎওয়া দেওয়া এযুগের একটি বড় মুছীবত’ (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর ১/৩০৬)।
২৬. কুরআন শিক্ষা প্রসঙ্গে :
‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে কুরআন শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়’ হাদীছটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুরআনের শিক্ষক হ’লেন সর্বোত্তম শিক্ষক এবং মানুষ যা কিছু শিক্ষা করে তার মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল কুরআন শিক্ষা করা। হায়! শিক্ষার্থীরা যদি এ সম্পর্কে জানতো, তাহ’লে তাদের জন্য বিরাট উপকার নিহিত ছিল। বর্তমান যুগে যে সমস্যা ব্যাপকতা লাভ করেছে সেটা হ’ল, তুমি বহু দাঈ এবং জ্ঞানান্বেষীকে দেখতে পাবে যারা দাওয়াত, ফৎওয়া ও মানুষের প্রশ্নের জবাবদানে তৎপর ভূমিকা রাখছে, অথচ তারা সুন্দরভাবে মাখরাজ সহকারে সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত করতে পারে না। কখনো তারা سকে ص , ط কে ت , ذ কে ز কিংবা ث কে س -এর মত উচ্চারণ করছে। কখনো সংগোপন উচ্চারণের স্থলে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছে। অথচ তাদের জন্য কুরআন হেফয করার চেয়ে কুরআন সুন্দরভাবে পড়তে শেখা একান্ত যরূরী। যাতে দ্বীনের দাওয়াত দান, পাঠদান ও ওয়ায-নছীহতের সময় সুন্দরভাবে আয়াত চয়ন এবং তা দ্বারা দলীল পেশ করতে পারে। তুমি তাদেরকে হাদীছ ছহীহ-যঈফ, ওলামায়ে কেরামের মতামত রদ এবং বিভিন্ন মতের মধ্যে তারজীহ দিতে দেখবে। দেখবে সর্বদা তাদের জ্ঞানের স্তরের চেয়ে উচ্চ স্তরের কোন বিষয়ে কথা বলতে। কখনো দেখবে তারা বলছে, ‘আমি এটা মনে করি’, ‘আমি বলি’, ‘এ বিষয়ে এটা আমার বক্তব্য’ অথবা ‘এ মতটিই আমার নিকটে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত!’
আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, তুমি তাদের অধিকাংশকে কখনো ওলামায়ে কেরামের মতৈক্যপূর্ণ মাসআলা নিয়ে আলোচনা করতে দেখবে না; বরং সর্বদাই দেখবে তারা বিরোধপূর্ণ মাসআলা নিয়ে আলোচনা করছে। এমনকি বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় লিপ্ত হচ্ছে, আর কঠিন হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন মতামত থেকে একটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আমি আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এ ধরনের লোকপ্রদর্শনী ও লোক শুনানোর লালসা এবং আত্মপ্রচারমুখী মনোভাব থেকে। আমি প্রথমে নিজেকে তারপর ঐসব ব্যক্তিদেরকে উপদেশ দিচ্ছি এ মর্মে যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পবিত্র কুরআন হেফয করার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন শুরু করা উত্তম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও’ (ক্বাফ ৫)। (আদ-দুরার আল-গাওয়ালী মিন কালামিল আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী, পৃঃ ২৪৫)।
মুসলিম যুবক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে
শায়খ আলবানীর নছীহত
প্রথমতঃ তোমরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই ইলম অর্জন করবে। এর বিনিময়ে কোন প্রতিদান, কোন শুকরিয়া বা কোন মজলিস আলোকিত করার অভিলাষ পোষণ করবে না। বরং তোমাদের লক্ষ্য থাকবে কেবল সেই মর্যাদা অর্জন, যা আল্লাহ তা‘আলা কেবল ওলামায়ে কেরামের জন্যই নির্ধারণ করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যে বিপদে আছে, তা থেকে তোমরা দূরে থাকবে। সেগুলি হ’ল, তাদের উপর জ্ঞানের অহংকার ও আত্মম্ভরিতা প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ফলে তাদের কেউ কেউ অহংকারের এত ঊচ্চ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে যে, সালাফে ছালেহীনের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে তারা কোন বিষয়ে নিজের মত করে ফৎওয়া দিচ্ছে। অথচ সালাফে ছালেহীন আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক আলোকোজ্জ্বল জ্ঞানভান্ডার। যা থেকে আমরা যুগ-যুগান্তরে আপতিত বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে সাহায্য গ্রহণ করতে পারি এবং বিভিন্ন মতবাদের ধোঁয়াশা ভেদ করে কিতাব ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকোজ্জ্বল মৌল উৎসের দিকে ফিরে যেতে পারি।
তোমরা নিশ্চয়ই জান যে, আমি নিজে এমন এক যুগে বসবাস করেছিলাম যেখানে বিরাজ করছিল দু’টি পরস্পরবিরোধী অবস্থা। সে যুগের মুসলমানরা সকলেই ছিল শিক্ষক কিংবা সাধারণ ছাত্র এবং তারা সকলেই কেবল বিভিন্ন মাযহাবেরই মুকাল্লিদ নয়, বরং বাপ-দাদাদের আচরিত বিভিন্ন রীতি-নীতিরও অনুসারী ছিল। এরূপ মতবাদ বিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝেও আমরা ও আমাদের মত অন্যান্য দেশের অনেক ভাইয়েরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিয়ে গিয়েছি।
আজ সে অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে এবং সমাজে সেই স্বল্পসংখ্যক সংস্কারকদের দাওয়াতের ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষতঃ বিভিন্ন দেশে যুবক শ্রেণী অধিকহারে এ দাওয়াত গ্রহণ করছে। দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জনে তাদের মাঝে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল এ ইতিবাচক জাগরণের পাশাপাশি এই যুবকদের অনেকেই আবার আত্মগর্ব ও আত্ম অহংকারের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কেবল যুবক শ্রেণীই নয়, বরং এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বহু আলেম। যারা দ্বীনের ছহীহ ইলমের অধিকারী হওয়ার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে বরং নিজেদেরকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানকারী ওলামায়ে কেরামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা শুরু করেছে এবং ভাবছে যে তারা বুঝি কিছু একটা হয়ে গেছে। ফলে কিতাব ও সুন্নাতের গভীর পান্ডিত্য ছাড়াই বিভিন্ন বিষয়ে তারা অপরিপক্ক ফৎওয়া প্রদান করছে। অথচ তাদের ধারণা তাদের ফৎওয়া নিশ্চয়ই কুরআন ও হাদীছ মোতাবেক হচ্ছে। ফলে এর দ্বারা তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে এবং পথভ্রষ্ট করছে বহু মানুষকে। উদাহরণস্বরূপ একটি দলের কথা বলা যায়, যাদেরকে আপনারা অনেক মুসলিম দেশেই দেখছেন। এই দলটি অন্যান্য সকল মুসলিম দলকে কাফের ঘোষণা করছে।
সুতরাং মুসলিম বিশ্বের সকল শিক্ষার্থী এবং দাঈ ভাইদের প্রতি আমার নছীহত হ’ল, তারা যেন ধৈর্য সহকারে জ্ঞানার্জন করে এবং নিজের অর্জিত জ্ঞান নিয়ে আত্মপ্রতারণার শিকার না হয়। তারা যেন এককভাবে নিজেদের বুঝ মোতাবেক না চলে। অর্থাৎ তাদের একক ‘ইজতিহাদে’র উপর নির্ভর করে ফৎওয়া না দেয়। কেননা আমি অনেক ভাইয়ের নিকটে শুনেছি, তারা নিজেদের ভুল হ’তে পারে এরূপ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই এবং কোন পরিণাম বিবেচনা না করেই খুব সহজে কোন বিষয়ে ফৎওয়া দিচ্ছে আর বলছে, أنا اجتهدت ‘আমি এ বিষয়ে ইজতিহাদ করেছি’। বলছে, ‘এটা আমার মত’, ‘এটা আমার মত নয়’ ইত্যাদি। যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কিসের ভিত্তিতে এরূপ ইজতিহাদ করলে? তুমি কি এক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাত, ছাহাবা ও তাবেঈন এবং ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমতের উপর নির্ভর করেছ? না নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও ক্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উপরে ইজতিহাদ করেছ? বাস্তবে দেখা যায়, সে এটাই করেছে। আমি মনে করি এর মূল কারণই হ’ল তাদের আত্মঅহমিকা ও নিজের ব্যাপারে অতি সুধারণা।
এজন্যই আমি মুসলিম বিশ্বের লেখকদের মাঝে একশ্রেণীর লেখকের বিস্ময়কর উত্থান লক্ষ্য করছি, যারা নিজেরা হাদীছের শত্রু; অথচ ইলমে হাদীছ বিষয়ে কিছু লিখছে। স্রেফ এটা যাহির করার জন্য যে, ইলমে হাদীছে তার অবদান রয়েছে। উক্ত লেখনীগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এখান থেকে সেখান থেকে নকল করে তারা বইগুলি সংকলন করেছে। এর কারণ কি? এর কারণ হ’ল তারা নিজেদেরকে সমাজে যাহির করতে চায় এবং মানুষের কাছে সস্তা খ্যাতি অর্জনের ধান্ধায় থাকে। সত্যিই নিম্নোক্ত প্রবাদটি তাদের জন্য খুব যথার্থ- حب الظهور يقطع الظهور ‘আত্মপ্রচারের লোভ খ্যাতি লাভের পথটিই রুদ্ধ করে দেয়’।
এজন্য আমি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সকল প্রকার ইসলামবিরোধী চরিত্র থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিচ্ছি। নিজের জ্ঞান নিয়ে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি এবং আত্মঅহমিকা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে বলছি। সাথে সাথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে কঠোরতা এবং রূঢ়তা পরিত্যাগ করে সর্বোত্তম পন্থা অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছি। কেননা আল্লাহ স্বীয় রাসূল (ছাঃ)- কে লক্ষ্য করে বলছেন, ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর’ (নাহল ১৬/১২৫)।
এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে এই কারণে যে, সত্য স্বভাবতঃই মানুষের জন্য একটি ভারী বিষয়। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত মানুষের পক্ষে তা গ্রহণ করাও কঠিন। এমতাবস্থায় যদি হক-এর সাথে আরো ভারী কিছু যুক্ত করা হয়, অর্থাৎ হক প্রচারের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়, তখন তা মানুষকে হক-এর নিকটবর্তী না করে বরং দূরে ঠেলে দেয়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) ৩ বার বলেছিলেন, إِنَّ مِنْكُمْ لَمُنَفِّرِينَ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ কেউ বিতাড়নকারী রয়েছে’ (আহমাদ হা/২২৩৯৮, সনদ ছহীহ)। আল্লাহ যেন আমাদেরকে এই বিতাড়নকারীদের অন্তর্ভুক্ত না করেন এবং কিতাব ও সুন্নাতের প্রাজ্ঞ অনুসারী হিসাবে কবুল করে নেন। আমীন! (মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, হায়াতুল আলবানী: আছারুহু ওয়া ছানাউল উলামা আলাইহে, ১/৪৫২)।
ইসলামী সমাজ বিনির্মানের পথ ও পদ্ধতি
সম্পর্কে শায়খ আলবানী
বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা হ’ল এই যে, তারা বস্ত্তগত শক্তিতে বলীয়ান কাফের রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং এমন সব শাসকদের হাতে নিপীড়িত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে না, আর করলেও তা খুব সামান্যই। যার ফলে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমি মনে করি মুসলিম দলগুলোকে কেবল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমি বিশ্বাস করি না এ দু’টি বিষয় ছাড়া মুসলমানদের এই দুর্বলতা, লাঞ্ছনা ও অপমান-অপদস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় আছে। আমি সকল বিশ্বাসী মুসলিম ভাই-বোনদেরকে বিশেষতঃ সচেতন ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবকদেরকে বলছি, প্রথমতঃ যে বিষয়টি আমাদের জানতে হবে তা হ’ল, মুসলমানদের করুণ পরিস্থিতি। আর দ্বিতীয়তঃ যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে তা হ’ল, সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে তা থেকে মুক্তির উপায় বের করার পথ অনুসন্ধান করা। কোটি কোটি মুসলমান আজ কেবল ভৌগলিক বাস্তবতা অথবা নিজের আত্মপরিচয় রক্ষার্থে মুসলিম। অর্থাৎ নিজের জাতীয়তা, পরিচয়পত্র এবং জন্মসনদে লিপিবদ্ধ পরিচিতি মোতাবেক মুসলিম। আজকে আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছুই বলব না। আমি পুনরায় সকলকে বলব, ঐ মুক্তিকামী যুবকদের হাতে মুক্তির কেবল দু’টি পথই খোলা আছে- (১) তাছফিয়াহ বা আক্বীদা সংশোধন (২) তারবিয়াত বা আমলী প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন।
তাছফিয়াহ হ’ল, মুসলিম যুবকদের নিকটে সেই বিশুদ্ধ ইসলামকে উপস্থাপন করা, যা যুগের পরিক্রমায় অনুপ্রবিষ্ট ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস, কুসংস্কার, বিদ‘আতসহ সকল প্রকার জাল-যঈফ হাদীছ হ’তে মুক্ত। এই আক্বীদাগত সংস্কারকে বাস্তবায়িত করা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। এই সংস্কার ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে কাংখিত শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার কোন সুযোগ নেই।
এই ‘তাছফিয়াহ’র উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলামকে একমাত্র চিকিৎসা হিসাবে উপস্থাপন করা, যা অনুরূপভাবে সেই আরবদের চিকিৎসা করেছিল, যারা একদিকে পারসিক, রোমীয়, হাবশীদের কাছে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত অবস্থায় পতিত ছিল। অন্যদিকে আল্লাহর পরিবর্তে গায়রুল্লাহর ইবাদত করতো।
এই অবস্থান থেকে আমরা সকল ইসলামী দল ও গোষ্ঠীর বিরোধিতা করি এবং বিশ্বাস করি অবশ্যই তাছফিয়াহ এবং তারবিয়াত একত্রে শুরু করতে হবে। যদি আমরা রাজনীতি দিয়ে শুরু করি তাহ’লে আমরা দেখতে পাব যে, যারা এখন রাজনীতিতে ডুবে রয়েছে, তাদের আক্বীদা বিনষ্ট। আর ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আচার-আচরণ অনেকটাই শরী‘আতবহির্ভূত। তারা কেবল আমভাবে ইসলামের নামে মানুষ জমায়েত করতেই ব্যস্ত। অথচ তাদের লক্ষ্য ও চিন্তাধারা সম্পর্কে ঐসব আমজনতার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনাচারে ইসলামের কোন প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের ব্যক্তিজীবনেই ইসলামী বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করে না, যা তাদের পক্ষে সহজেই সম্ভবপর ছিল। অথচ একই সময়ে তারা উঁচু গলায় শ্লোগান দিচ্ছে لا حكم إلا لله ‘আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কোন হুকুম চলবে না!’। বক্তব্যটি ঠিকই যে, অবশ্যই আল্লাহ নাযিলকৃত হুকুম ব্যতীত অন্য কোন হুকুম চলবে না। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, فاقد الشيء لا يعطيه অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি নিজে যা হারিয়েছে, সে অন্যকে তা দিতে পারে না’। আধুনিক কালের অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করে যদি অন্যদের কাছে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী ভূমিকা কামনা করে, তবে কখনোই তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হবে না। কেননা কেউ যদি কোন জিনিস নিজেই হারিয়ে ফেলে, তবে তা অন্যকে দিতে পারে না। আর ঐসব শাসকগণ তো এই উম্মতেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই শাসক-শাসিত উভয়কেই এ দুর্বলতার কারণ সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে কেন মুসলিম শাসকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামের বিধান অনুযায়ী শাসন করছে না? কেন মুসলিম দাঈগণ অন্যদেরকে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আহবান জানানোর পূর্বে নিজেদের জীবনে ইসলামী বিধান কার্যকর করছেন না। এর জওয়াব একটাই-তাদের কারোরই হয় ইসলাম সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান ছাড়া সঠিক জ্ঞান বা বুঝ নেই অথবা তারা চলাফেরা, জীবনযাপন, স্বভাবচরিত্র, পারস্পরিক লেনদেন কোন ক্ষেত্রেই ইসলামী মূল্যবোধের উপর গড়ে উঠেনি। ফলে আমার অভিজ্ঞতাবলে আমি যা বলতে পারি তারা বড় ধরনের ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। আর সেটি হ’ল দ্বীনের সঠিক বুঝ থেকে দূরে ছিটকে পড়া।
এমনকি আজকের দিনে কোন কোন দাঈ মনে করেন যে, সালাফীরা কেবল তাওহীদের দাওয়াতেই জীবনপাত করে গেল। সুবহানাল্লাহ, কতই না মূর্খতায় ডুবে আছে সেই ব্যক্তি, যে অজ্ঞতাবশতঃ এমন কথা বলে। যদি সে প্রকৃতপক্ষে গাফেল নাও হয়, তবুও সকল নবী ও রাসূলের দাওয়াত সম্পর্কে তার জানার কমতি আছে। কেননা সকল নবীর দাওয়াত ছিল, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বেঁচে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। নূহ (আঃ) ৯৫০ বছর যাবৎ কেবল এই দাওয়াতই দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নতুন কোন সংস্কার করেননি, কোন বিধান প্রবর্তন করেননি, কোন রাজনীতি করেননি। বরং তিনি কেবল বলেছিলেন, হে আমার কওম! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বেঁচে থাক’।
এটাই ছিল পূর্ববর্তী সালাফ আম্বিয়ায়ে কেরামের কার্যক্রম! তাহ’লে এই সকল মুসলিম দাঈগণ কিভাবে এত নীচে নেমে যেতে পারেন যে, তারা সেই একই কার্যক্রমের জন্য সালাফীদের নিন্দা করেন?
দ্বিতীয় উপায় হ’ল তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ। যুবকদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে যেন তারা পূর্ববর্তীদের মত দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَاللهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ. وَلَكِنِّى أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ ‘আল্লাহর কসম! তোমরা দারিদ্রে্য নিপতিত হবে এ আশংকা আমি করি না। বরং আমি ভয় করি যখন তোমাদের সামনে দুনিয়াবী চাকচিক্যের দুয়ার উন্মুক্ত হবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত। ফলে তাদের মত তোমরাও পরস্পর সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে এবং তা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে, যেভাবে ধ্বংস করেছিল পূর্ববর্তীদেরকে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৬৩)।
আরেকটি রোগ থেকে মুসলমানদের অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে যেন কোনভাবেই তা হৃদয়ে স্থান না পেতে পারে। তা হ’ল, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে ভয় না করা (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫৩৬৯)। এটা এমন একটি রোগ যার চিকিৎসা করা এবং মানুষকে তা থেকে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এর সমাধানটি একটি হাদীছের শেষাংশে রাসূল (ছাঃ) উল্লেখ করেছেন এভাবে, حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ ‘যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনের পথে ফিরে আসবে’ (আবুদাঊদ হা/৩৪৬২)। অর্থাৎ মুক্তির পথ প্রতিভাত হবে বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে ফিরে আসার মাধ্যমে, যে দ্বীনের উপর অটুট ছিলেন রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ ‘যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। মুফাসসিরগণ একমত যে, অত্র আয়াতে আল্লাহকে সাহায্য করা অর্থ হ’ল, তাঁর হুকুম-আহকাম অনুযায়ী আমল করা। সুতরাং আল্লাহকে সাহায্য করা যদি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন না করা ব্যতীত অসম্ভব হয়, তাহ’লে আমরা কিভাবে বাস্তব জিহাদে অবর্তীণ হব, যখন আমরা আল্লাহকে সাহায্য করছি না? কেননা আমাদের আক্বীদা যেমন অশুদ্ধ, নৈতিকতাও তেমন ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়েছে। সুতরাং জিহাদ শুরুর পূর্বে এই অবহেলা-উন্নাসিকতা আর বিবাদ-বিসম্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টাই হবে আমাদের আবশ্যকীয় প্রাথমিক কর্মসূচি। আল্লাহ বলেন, لاَ تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘তোমরা পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহ’লে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে’ (আনফাল ৮/৪৬)। সুতরাং যখন আমরা এই মতবিরোধ ও গাফিলতির পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হব এবং তদস্থলে পারস্পরিক ঐক্য-ভালোবাসার জাগরণ সৃষ্টি করতে পারব, তখন সেটাই হবে আমাদের দুনিয়াবী শক্তির মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন,أَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ ‘তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত কর’(আনফাল ৮/৬০)।
চারিত্রিক দিক থেকেও মুসলমানদের অবস্থা ধ্বংসাত্মক এবং মারাত্মক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তাইতো সালাফী নন এমন একজন বিখ্যাত মুসলিম দাঈর বক্তব্য (কাযী হাসান হুযায়মী) আমাকে বিস্মিত করেছে, যদিও তাঁর অনুসারীরা তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী চলেন না। তিনি বলেছেন, أَقِيْمُوْا دَوْلَةَ الْإِسْلاَمِ فِيْ قُلُوْبِكُمْ تُقَمْ لَكُمْ فِيْ أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’। অধিকাংশ দাঈ ভুল করেন যখন তারা আমাদের এই মূলনীতিকে অবহেলা করেন। একই ভুল করে বসেন যখন তারা বলে বসেন,
إن الوقت ليس وقت التصفية والتربية ، وإنما وقت التكتل والتجمُّع
‘এখন তো তাছফিয়াহ ও তারবিয়াতের সময় নয়। বরং এখন তো ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার সময়’। অথচ এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া কিভাবে সম্ভব হ’তে পারে যখন মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত নীতিতে বিভেদ বিরাজমান?… এ দুর্বলতাই আজ মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হ’ল যেটা আমি আগেই বলেছি, বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে যথাযথভাবে ফিরে আসা এবং সমাজে তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহর নীতি বাস্তবায়ন করা। আশা করি এটুকুই যথেষ্ট হবে। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক (মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু ওয়া ছানাউল উলামা আলাইহে ৩৭৭-৩৯১)।
জঙ্গীবাদী ও চরমপন্থীদের উদ্দেশ্যে
প্রথমতঃ কোন বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় প্রবেশের পূর্বে কিছু বিষয় স্মরণ রাখা যরূরী। জ্ঞানীগণ বলেন, ما بُني على فاسد فهو فاسد ‘বাতিলের উপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা নিজেও বাতিল’। উদাহরণস্বরূপ ছালাত যদি অপবিত্র অবস্থায় আদায় করা হয়, তবে তা ছালাত হিসাবে গণ্য হয় না। কেননা তা শরী‘আত নির্দেশিত বিধি মোতাবেক পালিত হয়নি। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ওযূবিহীন কোন ছালাত নেই’। তাই মুছল্লী ওযূবিহীনভাবে যত ছালাতই আদায় করুক না কেন, তা বাতিল বলেই গণ্য হবে। কেননা তা বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত। শরী‘আতে এরূপ উদাহরণ ভুরি ভুরি।
দ্বিতীয়তঃ আমরা সর্বদা বলে আসছি শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কেবলমাত্র তখনই জায়েয, যখন তার কুফরীর বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়। সাধারণভাবে কখনোই তা শরী‘আতসম্মত নয়। কেননা বিদ্রোহও শরী‘আতসম্মত উপায়ে হওয়া আবশ্যক। যেমনভাবে ছালাত আদায়ের জন্য পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক। এর প্রমাণে আমরা আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করব, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২১)।
তৃতীয়তঃ বর্তমানে মুসলমানরা এমন কিছু শাসকের শাসনাধীনে রয়েছে যাদেরকে ধরে নেওয়া যায় যে তারা মুশরিকদের মত সুস্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত। যদি এটা ধরে নেয়া হয় তবে আমি বলব, আজকের যুগের শাসকদের অধীনে মুসলমানরা যে অবস্থায় জীবন-যাপন করছে, এটা রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের মাক্কী জীবনের ন্যায়। রাসূল (ছাঃ)-কে তার মাক্কী জীবন কাফের-মুশরিকদের ত্বাগূতী শাসনের অধীনেই অতিবাহিত করতে হয়েছিল। যারা রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতকে এবং কালেমায়ে ত্বাইয়েবার আহবানকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করত। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আবু তালিবও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার দাওয়াতকে অস্বীকার করে বলেছিলেন, যদি আমার কওম আমার ব্যাপারে কটূক্তি না করত, তাহলে আমি অবশ্যই এ কালেমা উচ্চারণ করে তোমার চক্ষু শীতল করতাম।
তারা ছিল নবী (ছাঃ)-এর দাওয়াতের প্রকাশ্য অস্বীকার কারী। অথচ রাসূল (ছাঃ) তাদের শাসনাধীনেই বসবাস করতেন। তিনি তাদেরকে কোন কথাই বলতেন না কেবল একটি দাওয়াত ছাড়া, তা হ’ল- ‘তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কারো শরীক করো না’।
অতঃপর তিনি মাদানী জীবনে পদার্পণ করলেন। শারঈ বিধি-বিধান নাযিল হতে লাগল। মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের যুদ্ধ শুরু হ’ল। যার ইতিহাস সুবিদিত।
কিন্তু মাক্কী জীবনে কোন বিদ্রোহ ছিল না যেমনটি বর্তমানে অনেক অমুসলিম দেশে মুসলমানরা করছে। এরূপ বিদ্রোহ মূলতঃ রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ ছিল না। যার অনুসরণের জন্য আমরা নির্দেশিত হয়েছি।
চতুর্থতঃ বর্তমানে আলজেরিয়া সম্পর্কে আমরা যা শুনেছি তাহ’ল সেখানে দু’টি বা তারও বেশী দল রয়েছে, যারা শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। যেমন ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট এবং আমার জানা মতে তাদের মধ্যকার একটি জঙ্গী দল। এই চরমপন্থী অংশটি আসলে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী। এদের প্রত্যেকেরই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য নিজস্ব পথ ও পন্থা রয়েছে। এখন শাসককে নিজেদের মত করে কাফের ঘোষণা করে যদি এই দু’টি দলের কোন একটি দল বিজয় লাভ করে এবং ক্ষমতারোহন করে, তখন বাকি দলগুলোর কথা বাদই দিলাম, এ দু’টি দল কি ঐক্যমত পোষণ করতে পারবে? তারা কি সেই ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পারবে যার জন্য তারা যুদ্ধ করেছিল? মনে হয় না। কারণ অচিরেই তাদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হবে।
যার অতীব দুঃখজনক দৃষ্টান্ত আমরা আফগানিস্তানে দেখেছি। আফগানিস্তানে যেদিন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেদিন সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে শরীক হয়েছিল অনেকগুলি দল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা একে অপরের শক্রতে পরিণত হ’ল। সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথের বিপরীত কাজ করলে তার পরিণতি অবশেষে ধ্বংস ছাড়া কিছুই নয়। মূলতঃ ইসলামী হুকুমত কায়েমে এবং ইসলামের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথ হ’ল মানুষকে হক-এর পথে দাওয়াত দেয়া।
পঞ্চমতঃ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াত প্রদানের পদ্ধতি হ’ল, প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান করতে হবে। অতঃপর কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। এই দুই মূলনীতির পরিচয় আমরা দিয়েছি দু’টি শব্দ ‘তাছফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’ নামে। আমরা বলছি না যে, এর মাধ্যমেই সারা বিশ্বের মুসলমান একক উম্মাহ হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে; বরং আমরা বলতে চাই যে যারা প্রকৃতই ইসলামের জন্য কাজ করতে চায় অথবা সে পথের অনুসারী হতে চায়, যে পথে পৃথিবীতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা সম্ভব, তাদেরকে অবশ্যই হুকুম ও পদ্ধতিগতভাবে রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণ করা আবশ্যক।
এদিক থেকেই বলব মিসর ও আলজেরিয়ায় যা হচ্ছে, তা ইসলামের নীতি বিরোধী। কেননা ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে ‘তাছফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’-এর পথ অবলম্বন করতে; অন্য কোন পথ অনুসরণযোগ্য নয়। আমি বলছি না যে এর মাধ্যমেই লক্ষ লক্ষ মুসলমান সরল-স্বচ্ছভাবে ইসলামকে অনুসরণ করা শুরু করবে অথবা ইসলামের সঠিক পথ ও পন্থায় নিজেকে পরিচালিত করবে; বরং আমাদের বক্তব্য হ’ল ইসলামকে প্রকৃতই যারা গুরুত্ব দেয় তারা নিজেদের সংশোধন করুক, অতঃপর তার পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে সংশোধনের উদ্যোগ নিক, অতঃপর ক্রমান্বয়ে অন্যদেরকে। এভাবে সংশোধন ও সংস্কারের ধারা ক্রমান্বয়ে শাসক পর্যন্ত উপনীত হোক। এই শারঈ রীতি ও যৌক্তিক পন্থার অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল মানুষের মধ্যে সংশোধন ও সংস্কার আনা সম্ভব।
ষষ্ঠতঃ এই সকল বিপ্লব, বিদ্রোহ এমনকি আফগানিস্তানের জিহাদ, এসব ঘটনায় আমাদের কোন সমর্থন ছিল না কিংবা এর ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদীও ছিলাম না। কারণ সেখানে পাঁচ বা ততোধিক দল রয়েছে। যেমন বর্তমানে আফগানিস্তানে যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি ছুফী মতাবলম্বী বলে সুপরিচিত।
যাইহোক এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হ’ল, মতপার্থক্য যেকোন শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। যেমনভাবে আল্লাহ খুন-খারাবীর পিছনে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন পারস্পরিক বিভেদ। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ- مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ‘আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’। ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত’ (রূম ৩১-৩২)। সুতরাং মুসলমানরা যখন নিজেরাই দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন তাদের পক্ষে জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা এসকল বিভক্তি ও মতপার্থক্য দুর্বলতার চিহ্ন।
তাই বিজয়ী দলের বৈশিষ্ট্য হ’ল, যারা সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা কামনা করে, তারা আধুনিক যুগের জন্য প্রযোজ্য সেই বক্তব্যটিকে অনুসরণ করবে, যা একজন দাঈ উল্লেখ করেছিলেন, যদিও তাঁর অনুসারীরা তা অনুসরণ করে না। সে বক্তব্যটি হ’ল, ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কর, তবেই তোমাদের রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে’।
কিন্তু বাস্তবতায় আমরা যা দেখছি এসব ইসলামপন্থী সংগঠনের অধিকাংশই এই সংস্কার ও প্রশিক্ষণ নীতিকে সামনে রাখছেন না। এখনও তারা ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট অনৈসলামিক আক্বীদা, ইবাদাত, আখলাকগত ক্রটিগুলো সংস্কারে উদ্যোগী হচ্ছেন না। যারা নিজেদের ক্রটিগুলো সংস্কারেই আন্তরিক নন, সেখানে অন্যদের সংস্কারে কি পদক্ষেপ নিবেন! কোথায় রয়েছে শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব সংগঠনের সংস্কার ও সংশোধন নীতি বাস্তবায়ন কর্মসূচি?
সুতরাং আমি বলব, বিস্তারিত আলোচনার পর এটা সুস্পষ্ট যে, যে নীতি উল্লেখ করেছিলাম পূর্বেই অর্থাৎ ‘বাতিলের উপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা নিজেও বাতিল’, তারই বাস্তবতা লক্ষ্য করছি আমরা বিভিন্ন দেশে। আমাদের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার যে, আলজেরিয়া, মিসরসহ বিভিন্ন দেশে যা ঘটছে তা পূর্ববর্তী ঘটনা পরম্পরারই ফলশ্রুতি এবং সেইসাথে উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিতে শারঈ নীতিমালা লংঘনের দুঃখজনক পরিণাম।
সপ্তমতঃ আমরা জানি ন্যায়বিচারক ও প্রজ্ঞাবান শরী‘আত প্রণেতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছেন। যেমন প্রথম যুগের মুসলিম যোদ্ধাদেরকে মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাদ্রী, পুরোহিতদেরকেও আক্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল (আহমাদ হা/২৭২৮)। যদিও তারা শিরকে লিপ্ত এবং পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত; তবুও শরী‘আতপ্রণেতা মুসলিম যোদ্ধাদেরকে নিষেধ করেছিলেন ইসলামের একটি নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য। তাহ’ল আল্লাহ বলেন, … কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না’। ‘আর মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে’ (নাজম ৫৩/৩৮-৩৯)।
এই আয়াত থেকে আমরা দু’টি ইঙ্গিত পাই। একটি হ’ল কোন নারীকে হত্যা করা যাবে না, কেননা সে যুদ্ধ করে না। অপরটি হ’ল যদি সে পুরুষদের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়, তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে। এর ভিত্তিতে এখন যদি প্রশ্ন আসে যে, যারা টাইমবোমা বা গাড়িবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং এই বিস্ফোরণের ফলে এমন কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যে মূলতঃ শারঈ বিধান মোতাবেক দায়ী নয়; তাহ’লে কিভাবে এই কাজ ইসলামে জায়েয হতে পারে?
আমি তো বলব, এটা কেবল মূল ঘটনার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তার চেয়ে বেশী ধ্বংসাত্মক ঘটনা ছিল কয়েকবছর পূর্বে সংঘটিত সেই বিদ্রোহ। যেই বিদ্রোহ কেবল খারাপ প্রতিক্রিয়াই বয়ে আনছে ক্রমাগতভাবে। এজন্য আমরা বলি, সকল কাজ তার শেষ পরিণতির উপর নির্ভর করে। আর শেষ পরিণতি কখনই ভাল হয় না যতক্ষণ না তা প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামের উপর। সুতরাং যার ভিত্তিই হ’ল ইসলামবিরোধী, তা অচিরেই অনিষ্টকারিতা আর ধ্বংসের বার্তা বয়ে আনতে বাধ্য’ (সংক্ষেপায়িত)। (www.alalbany.net/misc024.php)।
[২৩.১০.১৯৯৫ তারিখে শায়খ আলবানীকে জিহাদের প্রকৃতি, বোমাবাজি ও গুপ্তহত্যার বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হ’লে তিনি উপরোক্ত উত্তরটি প্রদান করেন]
– আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
তথ্যসূত্র :
১. ইছাম মূসা হাদী, মুহাদ্দিছুল ‘আছর ইমাম মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী কামা ‘আরাফতুহু, (জুবাইল : দারুছ ছিদ্দীক্ব, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ ইং)।
২. সুমাইর বিন আমীন যুহায়ী, নাছেরুদ্দীন আলবানী, (রিয়ায : দারুল মুগনী, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ ইং)।
৩. মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ, (মিসর : দারুল গাদ জাদীদ, ১ম প্রকাশ ২০০৬ ইং)।
৪. ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার, (রিয়ায: দারুত তাওহীদ, ১ম প্রকাশ ২০০৮ ইং)।
৫. মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, হায়াতুল আলবানী : আছারুহু, ছানাউল উলামা আলাইহে, (কায়রো : মাকতাবা সাদাবী, ১ম প্রকাশ ১৯৮৭ ইং)।
৬. আতিয়া বিন ছিদক্বী, ছাফহাতুন বায়যা মিন হায়াতিল ইমাম (সানা : দারুল আছার, ২য় প্রকাশ ২০০১ ইং)।
৭. এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।
৮. ৩৭ হিজরী থেকেই বাতিলপন্থীরা মাথা চাড়া দেয়, যাদের হাতে হযরত ওছমান ও পরে হযরত আলী (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে ১ম শতাব্দী হিজরীর ১ম ভাগ থেকেই সাবাঈ, খারেজী, শী‘আ এবং ২য় ভাগে ক্বাদারিয়া, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত ফেরকা সমূহ জন্মলাভ করে। অতঃপর চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে এসে হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী প্রভৃতি তাক্বলীদী মাযহাবসমূহের প্রচলন ঘটে।