মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী
[বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর যেলাধীন পার্বতীপুর সদর উপযেলার খোলাহাটি রেল ষ্টেশনের নিকটবর্তী ‘বস্তীর আড়া’ বা (পরবর্তী নাম) ‘নূরুল হুদা’ গ্রামে মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোয়ায়শী (১৯০০-১৯৬০ খৃ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর পর এখানেই কবরস্থ হন। পিতা মাওলানা আব্দুল হাদী মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী (১৮০৫-১৯০২ খৃ.)-এর ছাত্র ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি ‘আহলেহাদীছ’ হন। পিতৃকুলে তিনি চট্টগ্রাম যেলার রাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামের সৈয়দ খোশহাল মুহাম্মাদ-এর সাথে এবং মাতৃকুলে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান যেলাধীন রসূলপুর পরগণার টুব গ্রাম নিবাসী পীর শাহ দিরাসাতুল্লাহর সাথে সম্পর্কিত। এই পীর হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর বংশধর বলে পরিচিত ছিলেন। মাওলানার মা উম্মে সালমা ছিলেন তাঁর পৌত্রী। এভাবে মায়ের দিক দিয়ে প্রথম খলীফা আবুবকর (রাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত হওয়ার ধারণা থেকেই সম্ভবতঃ মাওলানা কাফী নিজের নামের শেষে ‘আল-কোরায়শী’ লিখতেন।
মাত্র ৬ বছর বয়সে পিতৃহারা আব্দুল্লাহেল কাফী প্রথমে স্বগ্রামে, অতঃপর ৯ বছর বয়সে রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন হাইস্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে হুগলী যেলা স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণী পাস করেন। অতঃপর কলিকাতা মাদরাসায় স্কুল সেকশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স মিশনারী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বি.এ. পাঠরত অবস্থায় বৃটিশবিরোধী ‘অসহযোগ আন্দোলনে’ যোগ দেন ও ছাত্রজীবনের সমাপ্তি টানেন (ঐ, জীবনী ৬ পৃ.)।
১৯৪২ সালে হজ্জ থেকে ফিরে তিনি সক্রিয় রাজনীতি হ’তে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর রংপুরের হারাগাছে ১৯৪৬ সালে তাঁর উদ্যোগে বিরাট আহলেহাদীছ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে তাঁকে সভাপতি করে ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহ্লেহাদিছ’ গঠিত হয়। দেশবিভাগের পর ‘পূর্ব পাক জমঈয়তে আহলেহাদীছ’ এবং বর্তমানে তা ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস’ নামে পরিচিত।
অপূর্ব বাগ্মীতা ও পান্ডিত্যপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৪৯ হ’তে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুগটি ছিল মাওলানার সাহিত্য সাধনার স্বর্ণযুগ। ১৯৪৯ সালের মে মাসে পাবনা হ’তে উচ্চাংগের মাসিক ‘তর্জুমানুল হাদিছ’ (পরের বানান তর্জুমানুল হাদীছ[1]) প্রকাশ করেন। যা তাঁর মৃত্যুর পরেও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জারী ছিল। উক্ত পত্রিকায় সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় মতামত সমূহ প্রকাশিত হ’ত। আমরা সেখান থেকে আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কিত তাঁর মূল্যবান কিছু বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করলাম। যা এ যুগের আহলেহাদীছ ও অন্যান্যদের চিন্তার দুয়ার খুলতে সহায়ক হবে।
উল্লেখ্য যে, সে যুগের বানান পদ্ধতি ও বাক্য বিন্যাস এ যুগের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে মিলবে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য ও বানান রীতির বিবর্তনে এগুলি চিন্তার খোরাক হবে। বর্তমান নিবন্ধে মাওলানা ‘ইছলামী জামাআত’ বলতে মাওলানা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খৃ.) প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামী’কে বুঝিয়েছেন। অনেকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি অত্র মতামত প্রকাশ করেন। এই সাথে তাঁর লিখিত ও হা.ফা.বা. প্রকাশিত ‘একটি পত্রের জওয়াব’ পুস্তিকাটি পাঠ করার অনুরোধ রইল (স.স.)]।
ইছলামী জামাআত-বনাম আহলেহাদীছ আন্দোলন
ইছলামী জামাআত সম্পর্কে অনেকদিন হইতে আমরা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসিত হইয়া আসিতেছি। অনিবার্য কারণ ব্যতীত কাহারও সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া আমাদের রীতি বিরুদ্ধ বলিয়া উল্লিখিত দল সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে কিছু বলা এযাবত আমরা সমীচীন মনে করি নাই, কিন্তু সম্প্রতি সাধারণ মুছলিম উলামা সমাজ বিশেষতঃ আহ্লেহাদীছ- আন্দোলন সম্পর্কে ইছলামী জামাআতের ইমামে-আ’যম হইতে আরম্ভ করিয়া নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও যে ভাব-গতিক দেখাইতেছেন, তজ্জন্য কয়েকটি কথা ব্যক্ত করা অবশ্য- কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
ফির্কা ও আন্দোলনের পার্থক্য,
দল অর্থাৎ ফির্কা এবং আন্দোলনর মধ্যভাগে যে বৈষম্য সুস্পষ্ট সীমারেখা টানিয়া দিয়াছে তাহার মোটামুটি বিবরণ এইযে, দলের আদর্শ এবং কার্যসূচী কোন- ব্যক্তিত্বকে আশ্রয় ও নির্ভর করিয়াই উদ্ভাবিত এবং রূপায়িত হইয়া থাকে। ফির্কাবন্দীর ভিতর ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রত্ব এরূপ অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় যে, আদর্শের নিষ্ঠা ও কার্যক্রমের অনুসরণের দিক দিয়া কোন ব্যক্তি যতই অগ্রণী হউক না কেন, ফির্কার নেতার প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে আনুগত্যপরায়ণ না হওয়া পর্যন্ত তাহার নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতার কোন মূল্যই স্বীকৃত হয়না। পক্ষান্তরে আদর্শবাদ ও কর্মপরায়ণতা অপেক্ষা ফির্কাবন্দীর ভিতর দলীয় নেতার আনুগত্য ও অন্ধ অনুসরণই অধিকতর মূল্যবান বিবেচিত হইয়া থাকে। কালক্রমে এরূপও দেখিতে পাওয়া যায় যে, দলপতির ভ্রমপ্রমাদগুলিরও ফির্কাপরস্তের দল একান্ত শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে, মূল আদর্শ ও কর্মসূচীর সহিত দলপতির ব্যক্তিগত উক্তি ও আচরণের ব্যতিক্রম সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও অন্ধ ভক্তরা তাহাদের নেতার উক্তি ও আচরণকেই অগ্রগণ্য করিতেছে। পরিণামে ফির্কাবন্দীতে আদর্শ ও কর্মের সমুদয় ঝঞ্ঝাট বিদূরিত হইয়া দলীয় অহমিকতা ও ফির্কাপরস্তীর আত্মম্ভরিতাই সমুদয় স্থান জুড়িয়া বসে।
আহ্লেহাদীছ ফির্কা বা দল নয়,
একথা কাহাকেও বলিয়া দিতে হইবেনা যে, এই উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তিবিশেষকে আশ্রয় ও অবলম্বন করিয়া আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপিত হয় নাই। উম্মতের অন্তরভুক্ত কোন ব্যক্তিরই নিজস্ব দৃষ্টিভংগী ও উদ্ভাবিত কর্মপদ্ধতিকে আহ্লেহাদীছগণ তাহাদের দলীয় আকীদা এবং কর্মসূচী রূপে গ্রহণ করেন নাই। ফকীহ ও মুহাদ্দিছগণ দূরের কথা, ওলী, গওছ, কুতুব পরের কথা, ছাহাবা ও তাবেয়ীগণের মধ্যেও কোন মহান ব্যক্তিকে আহ্লেহাদীছগণ অভ্রান্ত ও মাছুম স্বীকার করিয়া লইয়া তাঁহাদের কোন ব্যক্তিবিশেষকে নির্ধারিত নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন নাই, সুতরাং এক নিঃশ্বাসে যাহারা অন্যান্য দল ও ফির্কার সহিত আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের নামও উচ্চারণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা হয় এই আন্দোলনের পটভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, অথবা সংকীর্ণতার বশবর্তী হইয়াই তাঁহারা আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের এই স্পষ্ট নিদর্শনটিকে উপেক্ষা করিয়া চলেন।
অন্যান্য ময্হবের সহিত আহ্লেহাদীছগণের পার্থক্য,
কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, কোরআন ও হাদীছের একচ্ছত্র অধিনায়কত্ব প্রতিপন্ন ও প্রতিষ্ঠা করা কি একমাত্র আহ্লেহাদীছ আন্দোলনেরই বৈশিষ্ট? আমরা সসম্মানে আরয করিব, -জ্বী হাঁ! আহ্লে ছুন্নতের অন্তরভুক্ত সমুদয় ফির্কাই নীতিগতভাবে হাদীছের প্রামাণিকতা ও প্রাধান্য স্বীকার করিয়া লইলেও দুইটি বিশেষ কারণে তাঁহাদের নির্দিষ্ট নেতা ও ইমামগণের সিদ্ধান্তই কার্যতঃ তাঁহাদের নিকট প্রামাণিকতার মৌলিক স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। প্রথমতঃ তাঁহাদের নেতাদের কোন উক্তি হাদীছের পরিপন্থী হইলে তাঁহারা হাদীছের পরোক্ষ ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন বটে, কিন্তু একটি স্থানেও তাঁহারা তাঁহাদের ইমামগণের সিদ্ধান্ত, বর্জন করিয়া রছুলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের অনুসরণ করিতে সাহসী হননা। দ্বিতীয়তঃ তাঁহাদের নেতাগণের পরিগৃহীত কোন রেওয়ায়ত তহ্কীক ক্ষেত্রে দুর্বল বা অপ্রামাণ্য সাব্যস্ত হইলেও তাঁহারা উহা পরিত্যাগ করিয়া তদপেক্ষা প্রামাণ্য ও বলিষ্ঠ রেওয়ায়ত অবলম্বন করেননা। আবার অনেকক্ষেত্রে নেতাগণের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকেই ভিত্তি করিয়া তাঁহারা ‘উপমান’ পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করিয়া থাকেন।
কিন্তু আহ্লেহাদীছগণ মতবাদ ও আচরণের দিক দিয়া রছুলুল্লাহর (দঃ) হাদীছকে চুল পরিমাণও অতিক্রম করিয়া যাইতে প্রস্ত্তত নহেন। বিশুদ্ধ হাদীছের সমকক্ষতায়, উহার বিপরীত যেকোন মহাবিদ্বান ও বিরাট পুরুষের উক্তি হউকনা কেন, তাঁহারা উহা মানিতে স্বীকৃত নহেন। কোন দুর্বল হাদীছকে বলিষ্ঠতর হাদীছের মুকাবিলায় গ্রহণ করিতে তাঁহারা কদাচ রাযী নহেন। ইহার জলজ্যান্ত প্রমাণ এইযে, সকল ফির্কাই স্ব স্ব ময্হবের মছ্আলাগুলি বিশেষভাবে সংকলিত করিয়া গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাঁহারা নিজেদের দলীয় মছ্আলার গ্রন্থগুলিকে নিজেদের গ্রন্থ এবং অপর দলের মছ্আলার পুস্তকগুলিকে ভিন্ন ময্হবের কিতাব বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন, কিন্তু আহ্লেহাদীছ বিদ্বানগণ রছুলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের চয়ন, সংকলন, সম্পাদন, ব্যাখ্যা ও আলোচনা ব্যতীত নিজেদের ময্হবের স্বতন্ত্র কোন কিতাব রচনা করেন নাই।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের পরিচয়,
আমাদের এই উক্তিগুলি যাঁহারা নিরপেক্ষ মনে বিচার করিতে সমর্থ, তাঁহারা ইহা স্বীকার করিয়া লইতে বাধ্য হইবেন যে, আহলেহাদীছ কোন নির্দিষ্ট দল বা ফির্কার নাম নয়, বরং তাঁহারা ফির্কাপরস্তী এবং দলবন্দীর বিরোধ করিতে এবং সমগ্র মুছ্লিম জাতিকে এক ও অভিন্ন কেন্দ্রে- সমাবেশিত করিতে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন, কিন্তু কোরআন ও হাদীছের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পুনর্গঠন ও সংস্কারের কার্য এরূপ সুদূর প্রসারী ও বিভাগ বহুল যে, আহ্লেহাদীছগণের সকলেই একই নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে চলিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারেন নাই। তাঁহাদেরই একদল এই দেশে লেখনীর সাহায্যে কোরআন ও ছুন্নতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা এবং দার্শনিক তত্ত্ব সম্বলিত সহস্র সহস্র গ্রন্থ ও সাহিত্য রচনা করিয়াছেন। মাত্র অল্প কিছুদিন পূর্বেও জনৈক আহ্লেহাদীছ মহাবিদ্বান আল্লামা ছৈয়েদ ছিদ্দীক হাছান (রহঃ) একাই ক্ষুদ্র বৃহৎ পাঁচ শতাধিক[2] গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ভারতের ইতিহাসে এরূপ গ্রন্থকারের দৃষ্টান্ত মুগল রাজত্বকালেও সুলভ নয়। ইহাদেরই আর একটি দল তাঁহাদের সমস্ত জীবন শুধু কোরআন ও হাদীছের অধ্যাপনা কার্যে উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের সাধনার ফলেই হিন্দ ও বাংলার ঘরে ঘরে রছুলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের পবিত্র প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। এই আহ্লেহাদীছগণেরই একদল শির্ক ও বিদ্আতের প্রতিরোধকল্পে এবং তওহীদ ও ছুন্নতের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কান্দাহার হইতে সিংহল পর্যন্ত এবং নেপালের তরাই হইতে আরম্ভ করিয়া সুন্দরবন পর্যন্ত পথে পথে ঘুরিয়া কে কোন্ স্থানে যে মৃত্যু বরণ করিয়াছেন, তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা দুঃসাধ্য। আহ্লেহাদীছগণেরই আর একটি দল পারিবারিক জীবনের মায়া এবং সুখ শান্তি পরিহার করিয়া নিষ্কাশিত তরবারি হস্তে ভারতের সীমান্তে দীর্ঘকাল যাবত সক্রিয় জিহাদে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। শুধু এই গুলিই নয়, শতাব্দীর উর্ধকাল যাবত পাক ভারতের যে কোন স্থানে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক যত প্রকার আন্দোলন জন্মপরিগ্রহ করিয়াছে, ‘ন্যায়ের সাহচর্য এবং অন্যায়ের অসহযোগ’ নীতির অনুসরণ করিয়া- আহ্লেহাদীছগণ সেগুলির প্রত্যেকটিতেই যোগদান করিয়াছিলেন।
যতদিন চন্দ্র সূর্য বিদ্যমান থাকিবে, যতদিন কোরআন ও হাদীছের বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠে জীবন্ত-জাগ্রত রহিবেই। নদীর স্রোত যেরূপ সকল ঋতুতেই খরতর থাকেনা,- তেমনি আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের স্রোতে কোন কোন সময়ে ভাটা দর্শন করিয়া এই আন্দোলনের পতন ও মৃত্যুর ধারণা পোষণ করা মূর্খজনোচিত ধারণা মাত্র।
ইছ্লামী জামাআতের স্বরূপ,
আহলেহাদীছ আন্দোলন যে দিকদিশারী মশাল প্রজ্জ্বলিত করিয়াছে, তাহারই আলোক আহরণ করিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ও এই উপমহাদেশে বহু সভামন্ডপ আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। এই আন্দোলনের ভাবাদর্শের আংশিক অনুকরণ করিয়াই ‘‘ইছ্লামী জামাআত’’ পাক ভারত উপমহাদেশে কোরআন ও হাদীছের সার্বভৌমত্ব ও ইছলামী জীবন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার কথা বারংবার উচ্চারণ করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আহ্লেহাদীছ আন্দোলনের রুচি ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত তাঁহারা একটি স্বতন্ত্র ফির্কাবন্দীর গোড়াপত্তন করিয়াছেন। দলীয় অহমিকতা, ফির্কাবন্দীর দাম্ভিকতা এবং অন্ধ গতানুগতিকতা পূর্ণভাবেই এই ফির্কাটিকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। তাঁহারা একথা ভুলিয়া গিয়াছেন যে, পৃথিবীর সত্তর কোটি[3] মুছলমান যত মতে এবং পথেই বিভক্ত হইয়া থাকুকনা কেন, একমাত্র ইছলামই তাঁহাদের সর্বসম্মত সম্পদ এবং মিলন কেন্দ্র! ইছলামের মহা সাগর তীর্থেই সকল ভেদ ও বৈষম্যকে জলাঞ্জলী দিয়া মুছলমানগণ একাত্মা হইয়াছেন। আর এই জন্যই কোন দলই ইছলামের এক-চেটিয়া অধিকারী বলিয়া দাবী করার স্পর্ধা কোনকালেই প্রকাশ করেন নাই কিন্তু এই তথাকথিত ‘ইছ্লামী জামাআতে’র স্পর্ধা যে, যে মানুষটিকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহাদের এই ফির্কা গজাইয়া উঠিয়াছে, কেবল সেইটিই হইতেছে ‘ইছ্লামী জামাআত’। এরূপ অভিমানের নযীর ইছলামের ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাস হইতে খুঁজিয়া বাহির করা দুঃসাধ্য।
অবশ্য ইছলামের বিভিন্ন দল ও ফির্কা সমূহের পরস্পর অসমঞ্জস ও বিরোধী মতবাদ সমূহের জগাখিচুড়ী প্রস্ত্তত করিয়া যদি ইছলামী জামাআতের নামে একটি ফ্রন্ট রচনা করা হইত, তাহা হইলেও হয়ত এই নামের সার্থকতা আংশিক ভাবে প্রতিপন্ন হইতে পারিত, কিন্তু কার্যতঃ আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী নামক ব্যক্তি এবং তাঁহার নিকট দীক্ষিত কতিপয় বিদ্বান ও অবিদ্বানের অভিমত ও উক্তিগুলিই ইছলামী জামাআতের সিদ্ধান্ত নামে কথিত হইয়াছে। তাঁহাদের আমীরে-আ’লার ‘তজ্দীদে দ্বীন’ শীর্ষক নিবন্ধে পূর্বেও প্রদর্শিত হইয়াছিল যে, ইছলামের প্রাথমিক যুগ হইতে আজ পর্যন্ত ‘সমগ্র ইছলামে’র উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠা দানের আন্দোলন কোন ইমাম, মুজতাহিদ, ফকীহ, মুহাদ্দিছ, ওলী, সাধক, রাষ্ট্রপতি ও মুজাদ্দিদ কেহই সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। ইছলামের তেরশত বৎসরের ইতিহাসে সামগ্রিক ভাবে ইছলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার উপযোগী যোগ্যতা ও ত্যাগের মহিমা একমাত্র তথাকথিত ইছলামী জামাআতের নেতারাই অর্জন করিয়াছেন। এই ফির্কার ইমামে- আ’যম তাঁহার দীর্ঘ কারাবাস হইতে মুক্ত হইয়া সম্প্রতি শেখুপুরায় যে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন, তাহাতেও তাঁহার সেই পুরাতন দাম্ভিকতার প্রতিধ্বনি সমান ভাবেই বিঘোষিত হইয়াছে। তিনি বলিতে চাহিয়াছেন, ধর্মের এবং জাতির সেবার কার্য তাঁহার দলটি ব্যতীত অন্য কোন সংঘ[4], পার্টি বা সমাজ কিছু মাত্র সমাধা করেন নাই। জম্ঈয়তে উলামাও নয়, আহরারও নয়, আহ্লে হাদীছরা ত একদমই নয়। তাঁহার এই দাম্ভিকতার অনস্বীকার্য প্রমাণ স্বরূপ তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, একমাত্র তাঁহারাই সরকারী কোপে পতিত হইয়াছেন। লাঞ্ছনা ও কারাবাসকে প্রোপাগান্ডার বিষয়বস্ত্ত রূপে প্রয়োগ করা ইছলামী আদর্শের সহিত কতদূর সুসমঞ্জস এবং এই বিবৃতির সত্যতাই বা কতটুকু, তাহার আলোচনা না করিলেও কার্য ও কারণের মধ্যে যে গভীর যোগাযোগের সন্ধান মওলানা ছৈয়েদ আবুল আলা প্রাপ্ত হইয়াছেন, ন্যায়শাস্ত্রের ছাত্রগণ তাহা উপলব্ধি করিয়া যে চমৎকৃত হইবেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
ইছলামী জামাআতের লেখক এবং নেতৃবৃন্দের অহমিকতা এইখানেই সমাপ্ত হয় নাই। মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বারংবার বিনা কারণে এই ধৃষ্ট উক্তিও ঘোষণা করিয়া বেড়াইতেছেন যে, ইছলাম-জগতে কোরআনের পরবর্তী সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও মাননীয় গ্রন্থ ছহীহ বুখারী প্রমাদবিহীন পুস্তক নয়। এ যাবত তিনি বুখারীর কোন সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন নাই অথবা উক্ত গ্রন্থে তিনি যে সকল প্রমাদের সন্ধান লাভ করিয়াছেন, উল্লেখ সহকারে সেগুলির প্রমাণ প্রদর্শন করিতেও সক্ষম হন নাই। সর্বোপরি বর্তমান সময়ে- যখন কোরআন ও ছুন্নতের প্রামাণিকতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে হাদীছ বৈরীগণ নানারূপ সন্দেহ ও দ্বিধার জাল বুনিতে চেষ্টা করিতেছে, ঠিক সেই আবাঞ্ছিত মুহূর্তে মওলানা মওদুদী ছাহেবের ছহীহ বুখারীর বিরুদ্ধে বিষোদগারের হেতুবাদ কি? তাঁহার রাছায়েল ও মাছায়েল পুস্তকে তিনি একথা বলিতে দ্বিধাবোধ করেন নাই যে, নমাযে রুকূতে যাওয়া ও রুকূ হইতে মস্তক উত্তোলন করার সময়ে হস্তোত্তোলন করা বা না করা, আমীন যোরে[5] উচ্চারণ করা বা না করা কোন নির্দিষ্ট দলের আচার এবং চিহ্নে পরিণত হইলে এবং উক্ত কার্য সমূহের বর্জন ও গ্রহণের উপর কোন দলের অন্তরভুক্ত বা বহির্ভূত হওয়া নির্ভর করিলে উল্লিখিত আচরণ গুলি অর্থাৎ হস্তোত্তোলন করা বা না করা, আমীন যোরে বা আস্তে বলা সর্বাপেক্ষা জঘন্য বিদ্আত হইবে। যাঁহারা হস্তত্তোলন করিয়া থাকেন, তাহাদের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য বিচার করার অধিকার মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী কোথায় প্রাপ্ত হইলেন? তাঁহার এই উক্তি দ্বারা তিনি তাঁহার অন্তর্নিহিত ‘‘আহলে হাদীছ বিদ্বেষ’’কেই প্রকটিত করেন নাই কি? এইরূপ এই দলটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নমায বিশুদ্ধ ভাবে প্রমাণিত বার তক্বীরের বিরুদ্ধেও তাঁহাদের মুখপত্র সমূহে যে কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন, তাহাতেও তাঁহাদের আহ্লেহাদীছ বিদ্বেষ সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিপন্ন হয় নাই কি?
মওলানা মওদুদী ছাহেব আহলে ছুন্নতগণের অন্যতম অধিনায়ক ইমাম আহমদ বিনে হাম্বলের এক খানা পত্র পাঠ করার সুযোগ কখনও পাইয়াছেন কি যাহাতে তিনি মুছদ্দদকে লিখিয়াছিলেন, ‘‘আহলেছুন্নতগণের কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ রহিয়াছে, তন্মধ্যে প্রথমটি হইতেছে, নমাযে ‘‘রফ্এ ইয়াদায়েন’’ করার কার্যকে পূণ্যবর্ধক মনে করা, দ্বিতীয়, ইমামের ‘ওয়ালায যাল্লীন’ বলার পর উচ্চৈঃস্বরে আমীন উচ্চারণ করা, তৃতীয়, মৃত আহলে কিবলা নমাযীর জানাযা পড়া, চতুর্থ, ভালমন্দ প্রত্যেক নেতার সংগে জিহাদের জন্য উত্থান করা, পঞ্চম, প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ অথবা দুশ্চরিত্র ইমামের পশ্চাতে নমায আদা’ করা, ষষ্ঠ, বিতরের নমায এক রাকআত পড়া, সপ্তম, সমুদয় আহলে ছুন্নতকে ভালবাসা’’।[6]
ইছলামী জামাআতের হঠকারিতা, সংকীর্ণতা এবং হাদীছ বিরোধী মনোবৃত্তির ফলে পাঞ্জাবের অনেক আলিম, যাঁহারা উহার প্রতি সভানুভূতিশীল এমনকি উহার অন্তরভুক্ত ছিলেন, শুধু আহ্লেহাদীছ থাকার অপরাধেই উক্ত দল বর্জন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইছলামী জামাআতের নেতা এবং তাঁহার অন্ধ ভক্তের দল মুছলিম জনসাধারণ এবং তাঁহাদের নেতৃবর্গকে যেরূপ নির্মম, নিষ্ঠুর ও অভদ্রোচিতভাবে অহরহই আক্রমণ করিয়া থাকেন, তাহার ফলে বিদ্বানগণের অন্তঃকরণ উক্ত জামাআতের বিরুদ্ধে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। ইছলামী জামাআত অন্য কোন দলের কোন আচরণ বা সেবাকে গ্রাহ্যের মধ্যে না আনিলেও এবং এই দলের নিকট হইতে কোনরূপ শিষ্টাচারের প্রত্যাশী না থাকিলেও আমরা স্বয়ং উক্ত দলের নেতা এবং তাঁহাদের উত্তম কার্যগুলি সর্বদা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে কখনও কার্পণ্য করি নাই কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই দলটি ফির্কাবন্দীর অভিশাপে যেভাবে আক্রান্ত হইতে চলিয়াছে, নীতিনৈতিকতার সমুদয় পুরাতন বাগাড়ম্বরের মুখে ছিপি অাঁটিয়া এখন তাঁহারা প্রকাশ্য ভাবে যেরূপ মামলা মোকদ্দমায় অবতীর্ণ হইয়াছেন, সক্রিয় রাজনীতির সমুদয় কলুষকে গায়ে মাখিয়া তাঁহারা যেভাবে প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র গোঠ রচনা করিতে উদ্যত হইয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের পুরাতন ভক্ত ও অনুরক্তদের পক্ষে তাঁহাদের সম্বন্ধে শ্রদ্ধান্বিত থাকা আর সম্ভবপর হইতেছে না। সম্প্রতি এই দলটি তাঁহাদের বহুবিশ্রুত নীতিনৈতিকতার মাথা খাইয়া বিগত বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে তাঁহাদের বিতরিত সাহায্যের বিনিময়ে অজ্ঞ জনসাধারণকে তাঁহাদের দলে ভিড়াইবার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন।
আমাদের অভিমত,
আমরা পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করিতে চাই যে, মূলনীতির দিক দিয়া এই জামাআতের ভিতর কোন অভিনবত্ব নাই। রাজনৈতিক এবং ব্যবহারিক টেকনিকের দিক দিয়া ইঁহারা যে পথের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন, তাহা শুধু সংহতি বিরোধীই নয়, বরং উহা মুছলমানদিগকে এক অনিশ্চিত ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। অনাগত শতবর্ষ কাল আন্দোলন চালাইয়াও ইছ্লামী জামাআতের পক্ষে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কার, রাজনীতি, ধর্মসেবা ও তকওয়ার ক্ষেত্রে আহ্লেহাদীছগণের সমকক্ষতা লাভ করা সুদূর পরাহত। তাঁহাদের দলপরস্তী, গোঁড়ামী, অন্ধ অহমিকতা ও হাদীছবিদ্বেষ তাঁহাদিগকে ক্রমশঃ মুছলিম জনমন্ডলী হইতে দূরেই সরাইয়া রাখিবে।
[মাসিক তর্জুমানুল হাদীছ, সাময়িক প্রসঙ্গ/সম্পাদকীয় কলাম, ৬ষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৬২/১৯৫৫, পৃ. ৪১-৪৫]
[1]. এই বানানই সঠিক। কেননা ‘হাদীছ’ আরবী শব্দ। যেখানে ‘দাল’-এর পর ‘ইয়া’ রয়েছে এবং শেষ বর্ণ হ’ল ‘ছা’। ‘স’ লিখলে সেটি দ্বারা ‘সীন’ বুঝাবে। যা ভুল। কেননা ‘হাদীস’ অর্থ ‘ধরাশায়ী’। ‘হাদিছ’ লিখলে তার অর্থ হবে ‘নবোদ্ভূত’ এবং ‘হাদীছ’ লিখলে তার অর্থ হবে ‘বাণী’। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী। আর এটাই সঠিক (স.স.)।
[2]. ২২২ খানা বইয়ের কথা জানা যায় (থিসিস ৯০ পৃ.)।
[3]. ২০০৯ সালের হিসাব মতে ১৫৭ কোটি (উইকিপিডিয়া)।
[4]. মাওলানা কাফী ছাহেব ‘সংঘ’ বললেও তাঁর ভাতিজা ও পরবর্তী জমঈয়ত সভাপতি ছাহেব ‘সংঘ’-কে বৌদ্ধ শব্দ বলেন এবং সেকারণে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ নাম বর্জন করেন। অতঃপর ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ‘যুবসংঘে’র সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করেন (দ্রঃ সাপ্তাহিক আরাফাত ৩০/৪৮ সংখ্যা ২৪শে জুলাই ১৯৮৯ পৃ. ৫ কলাম ৩)। (স.স.)।
[5]. ‘যোর’ বানানই সঠিক। বর্তমানে ‘জোর’ লেখা হয়। যা ভুল। কেননা এটি ফার্সী শব্দ; যেটি ‘যা’ হরফ দ্বারা গঠিত (স.স.)।
[6]. এটি পত্রটির পূর্ণ অনুবাদ নয় (স.স.)। দ্রঃ ইবনু আবী ইয়া‘লা, ত্বাবাক্বাতুল হানাবিলাহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/৩৪২-৪৩ পৃ.।
http://at-tahreek.com/site/show/1449