Probondo

Kitab


আহলেহাদীছ কখনো জঙ্গী নয়।


বর্তমানে যেসব কথিত জঙ্গী ধরা পড়ছে, তারা নাকি সবাই ‘আহলেহাদীছ’। সরকারে নাকি এ নিয়ে টেনশন চলছে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর প্রতিবাদ করছি এবং জানিয়ে দিচ্ছি যে, অনেকে ছালাতে রাফাদানী হ’লেও আক্বীদায় ‘আহলেহাদীছ’ নয়। কেননা প্রকৃত ‘আহলেহাদীছ’ সর্বদা মধ্যপন্থী। তারা যেমন শৈথিল্যবাদী নয়, তেমনি চরমপন্থীও নয়। কেউ কেউ বিজাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদের অনুসারী হ’লেও ধর্মীয় আক্বীদার দিক দিয়ে তারা চরমপন্থী বা জঙ্গীবাদী নয়। অনেকে আক্বীদা মযবুত হওয়ার আগেই হয়তবা কোন ক্ষমতালোভী দলের বা স্বার্থান্ধ ব্যক্তির খপ্পরে পড়ে যায়। ফলে সে তখন আর ‘আহলেহাদীছ’ থাকে না। যদিও ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েনটা হয়তো বাকী থাকে।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার আহলেহাদীছকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করার জন্য তাদের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক সক্রিয় সংগঠনটির আমীর সহ কেন্দ্রের ও বিভিন্ন যেলার প্রায় ৪০জন নেতা-কর্মীকে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে আগস্টের মধ্যে গ্রেফতার করে। পরে সবাই অবশেষে বেকসুর খালাস পায়। যদিও সংগঠনের আমীরকে ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন কারাগারে থাকতে হয়। কিন্তু দেশে-বিদেশে সংগঠনকে বদনাম করার কাজটি তারা সেরে যায়। কেননা প্রশাসনে ও গোয়েন্দা বিভাগে তাদের লোকেরা রয়েছে। ফলে কথিত গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের জনৈক চিহ্নিত অধ্যাপক প্রায়ই সরকারকে জঙ্গী দলের তালিকা দেন ও গরম গরম বিবৃতি দিয়ে পত্রিকায় শিরোনাম হন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, দেশে ১৩২টি জঙ্গী সংগঠন আছে। তন্মধ্যে প্রথমটি ‘আফগান পরিষদ’ অতঃপর ২ ও ৩ ক্রমিকে রয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠিত দু’টি সংগঠন। তার গবেষণার যোগ্যতা এত বেশী যে, একই সংগঠনকে আরবী (৮১) ও ইংরেজী (১০৪) নামে দু’টি সংগঠন বানিয়েছেন। যারা এদেশে নেই। অধ্যাপক ছাহেব কেবল ইসলামী দলগুলির মধ্যেই জঙ্গী খুঁজে বেড়ান। অন্যেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে মানুষ খুন করে উল্লাস করলেও সেগুলি জঙ্গীপনা নয়। সরকারের উচিৎ ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী দেশবিরোধী এইসব লোকগুলিকে ধরে নিয়ে এদের নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা।  
বর্তমান সরকার একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, বিগত সরকার কেন আহলেহাদীছদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল? আমরা তো কোন দলেরই ভোটের বাক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী নই। কারণ ইসলামে নেতৃত্ব বা ক্ষমতার জন্য প্রার্থী হওয়ার কোন বিধান নেই। তাই আমাদের সংগঠন সর্বত্র দল ও প্রার্থী বিহীন ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গঠন করে। সেই সাথে আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসাবে ঘোষণা করা এবং তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে রাষ্ট্রীয় আইনের মূল ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানায়। তাহ’লে কি ছিল সে কারণ? কে না জানে যে, চারদলীয় জোটের বড় দলটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী। বাকী তিনটি ছিল ইসলামপন্থী। তার মধ্যে একটি দলই ছিল বড় এবং অন্যদের থেকে ভিন্ন। তাদের আক্বীদা মতে ‘দ্বীন হ’ল হুকূমতের নাম’ আর হুকূমত হ’ল বড় ইবাদত।... ‘ছওম ও ছালাত, হজ্জ ও যাকাত এবং যিকর ও তাসবীহ মানুষকে উক্ত বড় ইবাদত অর্থাৎ ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্ত্ততকারী ট্রেনিং কোর্স মাত্র’ (ইক্বামতে দ্বীন ২৫ পৃঃ)। এই আক্বীদার অনুসারী লোকেরা ব্যালট বা বুলেট যেকোনভাবেই হৌক ক্ষমতায় যাওয়াকেই বড় ইবাদত মনে করে। বাঁচলে গাযী মরলে শহীদ এই সুড়সুড়ি দিয়ে এদের অনুসারীরা ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।
উক্ত দর্শন বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অধিক প্রসার লাভের অন্যতম কারণ হ’ল, (১) মুসলিম বিশ্বকে করায়ত্ব করার জন্য জিহাদের অপব্যাখ্যা করে উক্ত চরমপন্থী আক্বীদাকে উস্কে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে দেশী ও বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করা। (২) ইসলামী পোষাকাদি ও বিধি-বিধানসমূহের বিরুদ্ধে সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা (৩) ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার করা (৪) ইসলামপন্থীদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা ও তাদের উপর মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং গুম-খুন ও অপহরণের মাধ্যমে সর্বত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করা। সর্বোপরি (৫) ইসলাম প্রচারের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করা। মূলতঃ এ চরমপন্থী দর্শন ইসলামের প্রথম যুগে ফেলে আসা খারেজী জঙ্গীবাদীদের দর্শন। যারা ৪র্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল নেকীর কাজ মনে করে। এই দর্শনের বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর কঠোর ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ রয়েছে (ইক্বামতে দ্বীন ৩৪-৩৫ পৃঃ)। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ জন্মলগ্ন থেকেই এই চরমপন্থী আক্বীদার কঠোর বিরোধিতা করে আসছে এবং সাংগঠনিকভাবে জনমত গঠন করে যাচ্ছে।
আমেরিকার RAND গবেষণা সংস্থার মতে মুসলিমদের মধ্যে মৌলিকভাবে চারটি দল রয়েছে। সেক্যুলার, মডারেট, ছূফী ও সালাফী। এদের মধ্যে প্রথম তিনটি দল পাশ্চাত্যের অতীব নিকটবর্তী, সালাফীগণ ব্যতীত’। ফলে আদর্শিক মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে মডারেটরা ক্ষমতায় গিয়ে সালাফীদের উপর চূড়ান্ত যুলুম করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ বড় দলটির ঘাড়ে চেপে। সালাফীদের সক্রিয় সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর সহ অন্যদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন তারা চালিয়েছিল চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে। সংগঠনকেও ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল। অতঃপর আল্লাহর ফায়ছালা নেমে আসে। আর এটাই আল্লাহর বিধান। তিনি বলেন, ‘যদি আল্লাহ মানুষকে একে অপরের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)। অথচ মযলূম এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কারু কৃপা ভিক্ষা করেনি আল্লাহর নিকটে ফরিয়াদ করা ব্যতীত।
যদি সে সময় অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারী অলৌকিকভাবে ফখরুদ্দীন আহমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় না আসত এবং তা দু’বছর দীর্ঘায়িত না হ’ত, তাহ’লে তারা ‘আন্দোলন’-এর আমীরকে ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিত এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে ধারণা করা যায়। গত ১৬ই অক্টোবরে’১৫-তে বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো উইকিলিক্সের ফাঁস করা রিপোর্টে সেটি প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস কর্তৃক ২০০৫ সালের ২০শে এপ্রিল বুধবার আমেরিকায় তার সরকারের নিকট প্রেরিত গোপন রিপোর্টে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে যে, We want him at least 14 years to let this movement die down. ‘আমরা চাই তাকে কমপক্ষে ১৪ বছর জেলে রাখতে। যাতে এই আন্দোলন মরে শেষ হয়ে যায়’। হ্যাঁ, যাতে ‘আহলেহাদীছ’-এর নিরপেক্ষ ও হক কথা বন্ধ হয়ে যায় এবং এর মূল দাওয়াতটাই শেষ হয়ে যায়। কারণ প্রচলিত জাহেলিয়াত সমূহের বিরুদ্ধে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ই একমাত্র দল, যারা নবীগণের তরীকায় মানুষকে ফিরক্বা নাজিয়াহর দিকে জামা‘আতবদ্ধভাবে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে। যারা চেয়ার পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের আক্বীদা পরিবর্তনকেই তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ!
গত ২৩শে ডিসেম্বর বুধবার রাজধানীর ফার্মগেট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলেম-ওলামা, ইমাম ও খতীবদের সঙ্গে ডিএমপির এক মতবিনিময় সভায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কোন মুসলমান আইএস হ’তে পারে না। ইহূদীরাই আইএসের জন্মদাতা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক এজেন্ট আলেমের রূপ ধরে এই কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইসলামকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করছে। এই চক্রকে রুখে দেওয়া ঈমানী দায়িত্ব’। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াঁ বলেছেন, কুরআন-সুন্নাহর বিধান কায়েম করতে পারলে কোনো ধরনের হানাহানি হয় না, এত পুলিশেরও প্রয়োজন হয় না’(ইনকিলাব, ২৪.১২.২০১৫)
ধন্যবাদ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ও ডিএমপি কমিশনারকে হক প্রকাশ করার জন্য। আমরা চাই, আপনারা নিরপেক্ষ হৌন! আদর্শকে  আদর্শ দিয়ে মুকাবিলা করুন। নিপীড়ন বন্ধ করুন। নইলে চরমপন্থীরা আরও উৎসাহিত হবে। যোগ্য আলেমদের সহযোগিতায় কুরআন-সুন্নাহর বিধানসমূহ জারী করুন! তাহ’লে ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হবেন। মনে রাখবেন, খলীফা ওমর (রাঃ) এবং প্রখ্যাত তাবেঈ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, ‘দ্বীনকে ধ্বংস করে তিনজন : (১) অত্যাচারী শাসকবর্গ (২) স্বেচ্ছাচারী ধর্মনেতাগণ (৩) ছূফী ও দরবেশগণ’। এই সঙ্গে আমরা আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই মর্মে যে, অন্যের কাছে শুনে নয়, বরং সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। সেই সাথে ইসলামের নামে চরমপন্থী দর্শনের অনুসারীদের বলব, তোমরা তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এস। খুন করে ও ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে কখনো মানুষকে হেদায়াত করা যায় না। এর ফলে তোমরা ইহকাল ও পরকাল দু’টিই হারাবে। এতে ইসলামের বদনাম হচ্ছে। অথচ লাভবান হচ্ছে শত্রুরা। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশে-বিদেশে কোটি কোটি নিরপরাধ মুসলমান। অতএব মৃত্যুর আগেই সাবধান হও। আল্লাহকে ভয় কর।
বর্তমানে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র যে স্রোত চলছে এবং হাযার হাযার ভাই-বোন এই হক দাওয়াতে জান্নাতের পথে ফিরে আসছে, তারা আল্লাহর রহমতে সকল প্রকার চরমপন্থী মতবাদ ও কথিত জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন। দেশের সর্বাধিক আহলেহাদীছ অধ্যুষিত রাজশাহী বিভাগ সহ দেশের কোথাও আজ পর্যন্ত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কোন কর্মী বিগত ও বর্তমান কোন সরকারের আমলে জঙ্গী তৎপরতা ও নাশকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়নি। ইনশাআল্লাহ হবেও না। কেননা তারা কখনোই উদ্ধত নয় এবং সমাজে হিংসা-হানাহানি ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী নয়। তারা কখনই হরতাল-ধর্মঘট করে না। গাড়ী ভাংচুর, রগ কাটা ও বোমাবাজি করে না। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী তারা সকল সরকারেরই আনুগত্য করে। তারা বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করে এবং সরকারের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করে। হে আল্লাহ! তুমি বাংলাদেশকে দেশী ও বিদেশী সকল প্রকার ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা কর -আমীন!(স.স.)
[দ্রঃ ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ পৃঃ ২৭, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৯-৪০; ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই ৬১, ৯৩ পৃঃ (সম্পাদক)]