Probondo

Kitab


বিষয়ঃ বিদ্‌’আত পরিচিতির মূলনীতি।




আল্লাহ্র নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন। আল-কুরআনে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অনুসন্ধান করে, তা কখনোই তার কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে না”। এ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণাও আল্লাহ্ আল-কুরআনে দিয়েছেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” এ ঘোষণার পর আল-কুরআন ও সুন্নাহ্র বাইরে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন বিষয় সংযোজিত হওয়ার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল এবং বিদআত তথা নতুন যে কোন বিষয় দ্বীনী আমল ও আকীদা হিসেবে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়াও হারাম হয়ে গেল। এ আলোচনায় বিদআতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি কিভাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত বিদআতগুলোকে সনাক্ত করা যায় সে সম্পর্কিত মূলনীতি তুলে ধরা হবে।

বিদআতের সংজ্ঞা :

বিদআত শব্দের আভিধানিক অর্থ হল: পূর্ববর্তী কোন নমুনা ছাড়াই নতুন আবিকৃত বিষয়। আর শরীয়তের পরিভাষায়: আল্লাহ্র দ্বীনের মধ্যে নতুন করে যার প্রচলন করা হয়েছে এবং এর পক্ষে শরীয়তের কোন ব্যাপক ও সাধারণ কিংবা খাস ও সুনির্দিষ্ট দলীল নেই। এ সংজ্ঞাটিতে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়:
১. নতুনভাবে প্রচলন অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না এবং এর কোন নমুনাও ছিল না।
২. এ নব প্রচলিত বিষয়টিকে দ্বীনের মধ্যে সংযোজন করা এবং ধারণা করা যে, এটি দ্বীনের অংশ।
৩. নব প্রচলিত এ বিষয়টি শরীয়তের কোন ‘আম বা খাস দলীল ছাড়াই চালু ও উদ্ভাবন করা।
সংজ্ঞার এ তিনটি বিষয়ের একত্রিত রূপ হল বিদআত, যা থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ শরীয়তে এসেছে। কঠোর নিষেধাজ্ঞার এ বিষয়টি হাদীসে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন, “তোমরা (দ্বীনের) নব প্রচলিত বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয় বিদআ‘ত এবং প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম তাঁর এক খুতবায় বলেছেন: “নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।

বিদআতের বৈশিষ্ট্য :

বিদআতের চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
১. বিদআতকে বিদআত হিসেবে চেনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন দলীল পাওয়া যায় না; তবে তা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মূলনীতিগত ‘আম ও সাধারণ দলীল পাওয়া যায়।
২. বিদআত সবসময়ই শরীয়তের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মাকাসিদ এর বিপরীত ও বিরোধী অবস্থানে থাকে। আর এ বিষয়টিই বিদআত নিকৃষ্ট ও বাতিল হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এ জন্যই হাদীসে বিদআতকে ভ্রষ্টতা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
৩. অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদআত এমন সব কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে হয়ে থাকে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবাদের যুগে প্রচলিত ছিল না। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ: বলেন, ‘বিদআত বলতে বুঝায় এমন কাজকে যা ছিল না, অতঃপর তা উদ্ভাবন করা হয়েছে’।
৪. বিদআতের সাথে শরীয়তের কোন কোন ইবাদাতের কিছু মিল থাকে। দু’টো ব্যাপারে এ মিলগুলো লক্ষ্য করা যায়:
প্রথমত: দলীলের দিক থেকে এভাবে মিল রয়েছে যে, কোন একটি ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণার ভিত্তিতে বিদআতটি প্রচলিত হয় এবং খাস ও নির্দিষ্ট দলীলকে পাশ কাটিয়ে এ ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণাটিকে বিদআতের সহীহ ও সঠিক দলীল বলে মনে করা হয়।
দ্বিতীয়ত: শরীয়ত প্রণীত ইবাদাতের রূপরেখা ও পদ্ধতির সাথে বিদআতের মিল তৈরী করা হয় সংখ্যা, আকার-আকৃতি, সময় বা স্থানের দিক থেকে কিংবা হুকুমের দিক থেকে। এ মিলগুলোর কারণে অনেকে একে বিদআত মনে না করে ইবাদাত বলে গণ্য করে থাকেন।

বিদআত নির্ধারণে মানুষের মতপার্থক্য:

বিদআত নির্ধারণে মানুষ সাধারণত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত:এক: দলীল  পাওয়া যায় না এমন প্রতিটি বিষয়কে এক শ্রেণীর মানুষ বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং এক্ষেত্রে তারা বিশেষ বাছ-বিচার না করেই সব কিছুকে (এমন কি মু‘আমালার বিষয়কেও) বিদআত বলে অভিহিত করছে। এদের কাছে বিদআতের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত।
দুই: যারা দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত সকল বিষয়কে বিদআত বলতে রাজী নয়; বরং বড় বড় নতুন কয়েকটিকে বিদআত বলে বাকী সবকিছু শরীয়তভুক্ত বলে তারা মনে করে। এদের কাছে বিদআতের সীমানা খুবই ক্ষুদ্র।
তিন: যারা যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র প্রকৃত বিদআতকেই বিদআত বলে অভিহিত করে থাকেন। এরা মধ্যম পন্থাবলম্বী এবং হকপন্থী।

বিদআতের  মৌলিক নীতিমালা:

বিদআতের তিনটি মৌলিক নীতিমালা রয়েছে। সেগুলো হল:১. এমন ‘আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্র নিকট সাওয়াবের আশা করা যা শরীয়ত সিদ্ধ নয়। কেননা শরীয়তের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হলÑ এমন আমল দ্বারা আল্লাহ্র নিকট সাওয়াবের আশা করতে হবে যা কুরআনে আল্লাহ নিজে কিংবা সহীহ হাদীসে তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম অনুমোদন করেছেন। তাহলেই কাজটি ইবাদাত বলে  গণ্য  হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে আমল অনুমোদন করেননি সে আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্র ইবাদাত করা হবে বিদআত।
২. দ্বীনের অনুমোদিত ব্যবস্থা ও পদ্ধতির বাইরে অন্য ব্যবস্থার অনুসরণ ও স্বীকৃতি প্রদান। ইসলামে একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, শরীয়তের বেঁধে দেয়া পদ্ধতি ও বিধানের মধ্যে থাকা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি ইসলামী শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণ করল ও তার প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি প্রদান করল সে বিদআতে লিপ্ত হল।
৩. যে সকল কর্মকাণ্ড সরাসরি বিদআত না হলেও বিদআতের দিকে পরিচালিত করে এবং পরিশেষে মানুষকে বিদআতে লিপ্ত করে, সেগুলোর হুকুম বিদআতেরই অনুরূপ।
জেনে রাখা ভাল যে, ‘সুন্নাত’-এর অর্থ বুঝতে ভুল হলে বিদআত চিহ্নিত করতেও ভুল হবে। এদিকে ইঙ্গিত করে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সুন্নাতকে বিদআত থেকে পৃথক করা; কেননা সুন্নাত হচ্ছে ঐ বিষয়, শরীয়ত প্রণেতা যার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর বিদআত হচ্ছে ঐ বিষয় যা শরীয়ত প্রণেতা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে অনুমোদন করেননি। এ বিষয়ে মানুষ মৌলিক ও অমৌলিক অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত হয়েছে। কেননা, প্রত্যেক দলই ধারণা করে যে, তাদের অনুসৃত পন্থাই হ’ল সুন্নাত এবং তাদের বিরোধীদের পথ হল বিদআত।”
বিদআতের উপরোল্লিখিত তিনটি প্রধান মৌলিক নীতিমালার আলোকে বিদআতকে চিহ্নিত করার জন্য আরো বেশ কিছু সাধারণ নীতিমালা শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যদ্দ্বারা একজন সাধারণ মানুষ সহজেই কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের ভিত্তিতে বিদআতের পরিচয় লাভ করতে পারে ও সমাজে প্রচলিত বিদআতসমূহকে চিহ্নিত করতে পারে। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বিদআত তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে নেয়া ও তা থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা। নীচে উদাহরণ স্বরূপ কিছু দৃষ্টান্তসহ আমরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় নীতিমালা উল্লেখ করছি।
প্রথম নীতি: অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের ভিত্তিতে যে সকল ইবাদাত করা হয়, তা শরীয়তে বিদআত বলে বিবেচিত। এটি বিদআত চি‎িহ্নত করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি। কেননা ইবাদাত হচ্ছে পুরোপুরি অহী নির্ভর। শরীয়তের কোন বিধান কিংবা কোন ইবাদাত শরীয়তের গ্রহণযোগ্য সহীহ দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না। জাল বা মিথ্যা হাদীস মূলতঃ হাদীস নয়। অতএব এ ধরনের হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া কোন বিধান বা ইবাদাত শরীয়তের অংশ হওয়া সম্ভব নয় বিধায় সে অনুযায়ী আমল বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অত্যধিক দুর্বল হাদীসের ব্যাপারে জমহুর মুহাদ্দিসগণের মত হল এর দ্বারাও শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।
উদাহরণ : রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে অথবা ২৭শে রজব যে বিশেষ শবে মি’রাজের সালাত আদায় করা হয় তা বিদআত হিসেবে গণ্য। অনুরূপভাবে নিসফে শা‘বান বা শবেবরাতের রাতে যে ১০০ রাকাত সালাত বিশেষ পদ্ধতিতে আদায় করা হয় যাকে সালাতুর রাগায়েব বলেও অভিহিত করা হয়, তাও বিদআত হিসেবে গণ্য।  কেননা এর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসটি জাল।
দ্বিতীয় নীতি: যে সকল ইবাদাত শুধুমাত্র মনগড়া মতামত ও খেয়াল-খুশীর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয় সে সকল ইবাদাত বিদআত হিসেবে গণ্য। যেমন কোন এক ‘আলিম বা আবেদ ব্যক্তির কথা কিংবা কোন দেশের প্রথা অথবা স্বপ্ন কিংবা কাহিনী যদি হয় কোন ‘আমল বা ইবাদাতের দলীল তাহলে তা হবে বিদআত।
দ্বীনের প্রকৃত নীতি হলÑ আল কুরআন ও সুন্নাহ্র মাধ্যমেই শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে জ্ঞান আসে। সুতরাং শরীয়তের হালাল-হারাম এবং ইবাদাত ও ‘আমল নির্ধারিত হবে এ দু’টি দলীলের ভিত্তিতে। এ দু’টি দলীল ছাড়া অন্য পন্থায় স্থিরীকৃত ‘আমল ও ইবাদাত তাই বিদআত বলে গণ্য হবে। এ জন্যই বিদআত পন্থীগণ তাদের বিদআতগুলোর ক্ষেত্রে শরয়ী দলীলের অপব্যাখ্যা করে সংশয় সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. বলেন, “সুন্নাতী তরীকার মধ্যে আছে এবং সুন্নাতের অনুসারী বলে দাবীদার যে সকল ব্যক্তি সুন্নাতের বাইরে অবস্থান করছে, তারা নিজ নিজ মাসআলাগুলোতে সুন্নাহ্ দ্বারা দলীল পেশের ভান করেন।”
উদাহরণ :১। কাশ্ফ, অন্তর্দৃষ্টি তথা মুরাকাবা-মুশাহাদা, স্বপ্ন ও কারামাতের উপর ভিত্তি করে শরীয়াতের হালাল হারাম নির্ধারণ করা কিংবা কোন বিশেষ ‘আমল বা ইবাদাতের প্রচলন করা।
২। শুধুমাত্র ‘আল্লাহ’ কিংবা হু-হু’ অথবা ‘ইল্লাল্লাহ’ এর যিকর উপরোক্ত নীতির আলোকে ইবাদাত ব’লে গণ্য হবে না। কেননা কুরআন কিংবা হাদীসের কোথাও এরকম যিকর অনুমোদিত হয়নি।
৩। মৃত অথবা অনুপস্থিত সৎব্যক্তিবর্গকে আহ্বান করা, তাদের কাছে প্রার্থনা করা ও সাহায্য চাওয়া, অনুরূপভাবে ফেরেশতা ও নবী-রসূলগণের কাছে দু‘আ করাও এ নীতির আলোকে বিদআত বলে সাব্যস্ত হবে। শেষোক্ত এ বিদআতটি মূলতঃ শেষ পর্যন্ত বড় শিরকে পরিণত হয়।
তৃতীয় নীতি: কোন বাধা-বিপত্তির কারণে নয় বরং এমনিতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল ‘আমল ও ইবাদাত থেকে বিরত থেকেছিলেন, পরবর্তীতে তার উম্মাতের কেউ যদি সে ‘আমল করে, তবে তা শরীয়তে বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
কেননা তা যদি শরীয়তসম্মত হত তাহলে তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। অথচ কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম সে ‘আমল বা ইবাদাত ত্যাগ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘আমলটি শরীয়তসম্মত নয়। অতএব সে ‘আমল করা যেহেতু আর কারো জন্য জায়েয নেই, তাই তা করা হবে বিদআত।
উদাহরণ:১। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমা‘ ছাড়া অন্যান্য সালাতের জন্য ‘আযান দেয়া। উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে।
২। সালাত শুরু করার সময় মুখে নিয়তের বাক্য পড়া। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবীগণ এরূপ করা থেকে বিরত থেকেছিলেন এবং নিয়ত করেছিলেন শুধু অন্তর দিয়ে, তাই নিয়তের সময় মুখে বাক্য পড়া বিদআত বলে গণ্য হবে।
৩। বিপদ-আপদ ও ঝড়-তুফান আসলে ঘরে আযান দেয়াও উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে। কেননা বিপদ-আপদে কী পাঠ করা উচিত বা কী ‘আমল করা উচিত তা হাদীসে সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে।
৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর জন্মোৎসব পালনের জন্য কিংবা আল্লাহর কাছে সাওয়াব ও বরকত লাভের প্রত্যাশায় অথবা যে কোন কাজে আল্লাহর সাহায্য লাভের উদ্দেশে মিলাদ পড়া উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে।
চতুর্থ নীতি: সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, ও তাবেয়ীন যদি কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও কোন ইবাদাতের কাজ করা কিংবা বর্ণনা করা অথবা লিপিবদ্ধ করা থেকে বিরত থেকে থাকেন, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তাদের বিরত থাকার কারণে প্রমাণিত হয় যে, কাজটি তাদের দৃষ্টিতে শরীয়তসিদ্ধ নয়। কারণ তা যদি শরীয়তসিদ্ধ হত তাহলে তাদের জন্য তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। তা সত্ত্বেও যেহেতু তারা কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই উক্ত ‘আমল ত্যাগ করেছেন, তাই পরবর্তী যুগে কেউ এসে সে ‘আমাল বা ইবাদাত প্রচলিত করলে তা হবে বিদআত।
হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “যে সকল ইবাদাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর সাহাবাগণ করেন নি তোমরা সে সকল ইবাদাত কর না।” মালিক ইবনে আনাস রহ. বলেন, “এই উম্মাতের প্রথম প্রজন্ম যে ‘আমল দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল একমাত্র সে ‘আমল দ্বারাই উম্মাতের শেষ প্রজন্ম সংশোধিত হতে পারে।”
ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. কিছু বিদআতের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেন, “এ কথা জানা যে, যদি এ কাজটি শরীয়তসম্মত ও মুস্তাহাব হত যদ্দ্বারা আল্লাহ সাওয়াব দিয়ে থাকেন, তাহলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অবহিত থাকতেন এবং অবশ্যই তাঁর সাহাবীদেরকে তা জানাতেন, আর তাঁর সাহাবীরাও সে বিষয়ে অন্যদের চেয়েও বেশী অবহিত থাকতেন এবং পরবর্তী লোকদের চেয়েও এ ‘আমলে বেশী আগ্রহী হতেন। কিন্তু যখন তারা এ প্রকার ‘আমলের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না তাতে বোঝা গেল যে, তা নব উদ্ভাবিত এমন বিদআত যাকে তারা ইবাদাত, নৈকট্য ও আনুগত্য হিসেবে বিবেচনা করতেন না। অতএব এখন যারা একে ইবাদাত, নৈকট্য, সাওয়াবের কাজ ও আনুগত্য হিসাবে প্রদর্শন করছে তারা সাহাবাদের পথ ভিন্ন অন্য পথ অনুসরণ করছেন এবং দ্বীনের মধ্যে এমন কিছুর প্রচলন করছেন যার অনুমতি আল্লাহ প্রদান করেননি।”
তিনি আরো বলেন, “আর যে ধরনের ইবাদাত পালন থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বিরত থেকেছেন অথচ তা যদি শরীয়াত সম্মত হত তাহলে তিনি নিজে তা অবশ্যই পালন করতেন, অথবা অনুমতি প্রদান করতেন এবং তাঁর পরে খলিফাগণ ও সাহাবীগণ তা পালন করতেন। অতএব এ কথা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে এ কাজটি বিদআত ও ভ্রষ্টতা।”
এর দ্বারা বুঝা গেল যে, যে সকল ইবাদাত পালন করা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম নিজে এবং তাঁর পরে উম্মাতের প্রথম প্রজন্মের আলিমগণ বিরত থেকেছিলেন নিঃসন্দেহে সেগুলো বিদআত ও ভ্রষ্টতা। পরবর্তী যুগে কিংবা আমাদের যুগে এসে এগুলোকে ইবাদাত হিসেবে গণ্য করার কোন শরয়ী‘ ভিত্তি নেই।
উদাহরণ :১। ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিবসসমূহ ও ঐতিহাসিক উপলক্ষগুলোকে ঈদ উৎসবের মত উদযাপন করা। কেননা ইসলামী শরীয়াতই ঈদ উৎসব নির্ধারণ ও অনুমোদন করে। শরীয়াতের বাইরে অন্য কোন উপলক্ষকে ঈদ উৎসবে পরিণত করার ইখতিয়ার কোন ব্যক্তি বা দলের নেই। এ ধরনের উপলক্ষের মধ্যে একটি রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর জন্ম উৎসব উদযাপন। সাহাবীগণ ও পূর্ববর্তী ‘আলিমগণ হতে এটি পালন করাতো দূরের কথা বরং অনুমোদন দানের কোন বর্ণনাও পাওয়া যায় না। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “এ কাজটি পূর্ববর্তী সালাফগণ করেননি অথচ এ কাজ জায়িয থাকলে সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে তা পালন করার কার্যকারণ বিদ্যমান ছিল এবং পালন করতে বিশেষ কোন বাধাও ছিল না। যদি এটা শুধু কল্যাণের কাজই হতো তাহলে আমাদের চেয়ে তারাই এ কাজটি বেশী করতেন। কেননা তারা আমাদের চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম-কে বেশী সম্মান ও মহব্বত করতেন এবং কল্যাণের কাজে তারা ছিলেন বেশী আগ্রহী।”
২। ইতোপূর্বে বর্ণিত সালাত-আর রাগায়েব বা শবে মি‘রাজের সালাত উল্লেখিত চতুর্থ নীতির আলোকেও বিদআত সাব্যস্ত হয়ে থাকে।
ইমাম ইযযুদ্বীন ইবনু আব্দুস সালাম রহ. এ প্রকার সালাত এর বৈধতা অস্বীকার করে বলেন, “এ প্রকার সালাত যে বিদআত তার একটি প্রমাণ হলো দ্বীনের প্রথম সারির ‘উলামা ও মুসলমানদের ইমাম তথা সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও শরীয়াহ বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়নকারী বড় বড় ‘আলিমগণ মানুষকে ফরয ও সুন্নাত বিষয়ে জ্ঞান দানের প্রবল আগ্রহ পোষণ করা সত্ত্বেও তাদের কারো কাছ থেকে এ সালাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় নি এবং কেউ তাঁর নিজ গ্রন্থে এ সম্পর্কে কিছু লিপিবদ্ধও করেন নি ও কোন বৈঠকে এ বিষয়ে কোন আলোকপাতও করেননি। বাস্তবে এটা অসম্ভব যে, এ সালাত আদায় শরীয়তে সুন্নাত হিসেবে বিবেচিত হবে অথচ দ্বীনের প্রথম সারির ‘আলিমগণ ও মু’মিনদের যারা আদর্শ, বিষয়টি তাদের সকলের কাছে থেকে যাবে সম্পূর্ণ অজানা”। [আত তারগীব ‘আন সলাতির রাগাইব আল মাওদুয়া, পৃঃ ৫-৯]
পঞ্চম নীতি: যে সকল ইবাদাত শরীয়াতের মূলনীতিসমূহ এবং মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্য ও লক্ষের বিপরীত সে সবই হবে বিদআত।
উদাহরণ :১. দুই ঈদের সালাতের জন্য আযান দেয়া। কেননা নফল সালাতের জন্য আযান দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। আযান শুধু ফরয সালাতের সাথেই খাস।
২. জানাযার সালাতের জন্য আযান দেয়া। কেননা জানাযার সালাতে আযানের কোন বর্ণনা নেই, তদুপরি এতে সবার অংশগ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও নেই।
৩. ফরয সালাতের আযানের আগে মাইকে দরূদ পাঠ। কেননা আযানের উদ্দেশ্য লোকদেরকে জামাআ’তে সালাত আদায়ের প্রতি আহ্বান করা, মাইকে দরূদ পাঠের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
ষষ্ঠ নীতিপ্রথা ও মু‘আমালাত বিষয়ক কোন কাজের মাধ্যমে যদি শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই আল্লাহর কাছে সাওয়াব লাভের আশা করা হয় তাহলে তা হবে বিদআত।
উদাহরণ :পশমী কাপড়, চট, ছেঁড়া ও তালি এবং ময়লাযুক্ত কাপড় কিংবা নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরিধান করাকে ইবাদাত ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার পন্থা মনে করা। একই ভাবে সার্বক্ষণিক চুপ থাকাকে কিংবা রুটি ও গোশত্ ভক্ষণ ও পানি পান থেকে বিরত থাকাকে অথবা ছায়াযুক্ত স্থান ত্যাগ করে সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে কাজ করাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পন্থা হিসাবে নির্ধারণ করা।
উল্লেখিত কাজসমূহ কেউ যদি এমনিতেই করে তবে তা নাজায়িয নয়, কিন্তু এ সকল ‘আদাত কিংবা মোয়ামালাতের কাজগুলোকে যদি কেউ ইবাদাতের রূপ প্রদান করে কিংবা সাওয়াব লাভের উপায় মনে করে তবে তখনই তা হবে বিদআত। কেননা এগুলো ইবাদাত ও সওয়াব লাভের পন্থা হওয়ার কোন দলীল শরীয়তে নেই।
সপ্তম নীতি: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল কাজ নিষেধ করে দিয়েছেন সেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সাওয়াব লাভের আশা করা হলে সেগুলো হবে বিদআত।
উদাহরণ :১। গান-বাদ্য ও কাওয়ালী বলা ও শোনা অথবা নাচের মাধ্যমে যিকর করে আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা করা।
২। কাফির, মুশরিক ও বিজাতীয়দের অনুকরণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সাওয়াব লাভের আশা করা।
অষ্টম নীতি: যে সকল ইবাদাত শরীয়তে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতির সাথে প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলোকে সে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতি থেকে পরিবর্তন করা বিদআত বলে গণ্য হবে।
উদাহরণ :১। নির্ধারিত সময় পরিবর্তনের উদাহরণÑ যেমন জিলহাজ্জ মাসের এক তারিখে কুরবানী করা। কেননা, কুরবানীর শরয়ী সময় হল ১০ জ্বিলহাজ্জ ও তৎপরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলো।
২। নির্ধারিত স্থান পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ই‘তিকাফ করা। কেননা, শরীয়ত কর্তৃক ই‘তিকাফের নির্ধারিত স্থান হচ্ছে মসজিদ।
৩। নির্ধারিত শ্রেণী পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন গৃহ পালিত পশুর পরিবর্তে ঘোড়া দিয়ে কুরবানী করা।
৪। নির্ধারিত সংখ্যা পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন পাঁচ ওয়াক্তের অতিরিক্ত ৬ষ্ঠ আরো এক ওয়াক্ত সালাত প্রচলন করা। কিংবা চার রাক‘আত সালাতকে দুই রাক‘আত, কিংবা দুই রাক‘আতের সালাতকে চার রাক‘আতে পরিণত করা।
৫। নির্ধারিত পদ্ধতি পরিবর্তনের উদাহরণ : অযু করার শরয়ী পদ্ধতির বিপরীতে যেমন দু‘পা ধোয়ার মাধ্যমে অযু শুরু করা এবং তারপর দু‘হাত ধৌত করা এবং মাথা মাসহ করে মুখমণ্ডল ধৌত করা। অনুরূপভাবে সালাতের মধ্যে আগে সিজদাহ ও পরে রুকু করা।
নবম নীতি: ‘আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক দলিল দ্বারা শরীয়তে যে সকল ইবাদাতকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে সেগুলোকে কোন নির্দিষ্ট সময় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান অথবা অন্য কিছুর সাথে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা বিদআত ব’লে গণ্য হবে যদ্দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ইবাদাতের এ সীমাবদ্ধ করণ প্রক্রিয়া শরীয়তসম্মত, অথচ পূর্বোক্ত ‘আম দলীলের মধ্যে এ সীমাবদ্ধ করণের উপর কোন প্রমাণ ও দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না।
এ নীতির মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন উন্মুক্ত ইবাদাতকে শরীয়াতের সহীহ দলীল ছাড়া কোন স্থান, কাল বা সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা বিদআত হিসেবে বিবেচিত।
উদাহরণ :১। যে দিনগুলোতে শরীয়াত রোযা বা সাওম রাখার বিষয়টি সাধারণভাবে উন্মুক্ত রেখেছে যেমন মঙ্গল বার, বুধবার কিংবা মাসের ৭, ৮ ও ৯ ইত্যাদি তারিখসমূহ, সে দিনগুলোর কোন এক বা একাধিক দিন বা বারকে বিশেষ ফযীলাত আছে বলে সাওম পালনের জন্য যদি কেউ খাস ও সীমাবদ্ধ করে অথচ খাস করার কোন দলীল শরীয়তে নেই, যেমন ফাতিহা-ই-ইয়াযদাহমের দিন সাওম পালন করা, তাহলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে তা হবে বিদআত, কেননা দলীল ছাড়া শরীয়াতের কোন হুকুমকে খাস ও সীমাবদ্ধ করা জায়িয নেই।
২। ফযীলাতপূর্ণ দিনগুলোতে শরীয়াত যে সকল ইবাদাতকে উন্মুক্ত রেখেছে সেগুলোকে কোন সংখ্যা, পদ্ধতি বা বিশেষ ইবাদাতের সাথে খাস করা বিদআত হিসাবে গণ্য হবে। যেমন প্রতি শুক্রবার নির্দিষ্ট করে চল্লিশ রাক‘আত নফল সালাত পড়া, প্রতি বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট পরিমাণ সদাকা করা, অনুরূপভাবে কোন নির্দিষ্ট রাতকে নির্দিষ্ট সালাত ও কুরআন খতম বা অন্য কোন ইবাদাতের জন্য খাস করা।
দশম নীতি: শরীয়াতে যে পরিমাণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে ইবাদাত করতে গিয়ে সে ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ‘আমল করার মাধ্যমে বাড়াবাড়ি করা এবং কঠোরতা আরোপ করা বিদআত বলে বিবেচিত।
উদাহরণ :১। সারা রাত জেগে নিদ্রা পরিহার করে কিয়ামুল লাইল এর মাধ্যমে এবং ভঙ্গ না করে সারা বছর সাওম রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং অনুরূপভাবে স্ত্রী, পরিবার ও সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদের ব্রত গ্রহণ করা। সহীহ বুখারীতে আনাস ইবনে মালেক (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর হাদীসে যারা সারা বছর সাওম রাখার ও বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালন না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল তাদের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছিলেন : “আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশী ভয় পোষণ করি এবং তাকওয়া অবলম্বনকারী। কিন্তু আমি সওম পালন করি ও ভাঙ্গি, সালাত আদায় করি ও নিদ্রা যাপন করি এবং নারীদের বিবাহ করি। যে আমার এ সুন্নাত থেকে বিরাগভাজন হয়, যে আমার দলভুক্ত নয়।
২। হাজ্জের সময় জামরায় বড় বড় পাথর দিয়ে রমী করা, এ কারণে যে, এগুলো ছোট পাথরের চেয়ে পিলারে জোরে আঘাত হানবে এবং এটা এ উদ্দেশ্যে যে, শয়তান এতে বেশী ব্যথা পাবে। এটা বিদআত এজন্য যে, শরীয়তের নির্দেশ হল ছোট পাথর নিক্ষেপ করা এবং এর কারণ হিসেবে হাদীসে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহর যিকর ও স্মরণকে কায়েম করা।”  উল্লেখ্য যে, পাথর নিক্ষেপের স্তম্ভটি শয়তান বা শয়তানের প্রতিভূ নয়। হাদীসের ভাষায় এটি জামরাহ। তাই সকল ক্ষেত্রে নিরাপদ হল হাদীস অনুযায়ী ‘আমল করা ও আকীদা পোষণ করা।
৩। যে পোষাক পরিধান করা শরীয়তে মুবাহ ও জায়েয, যেমন পশমী কিংবা মোটা কাপড় পরিধান করা তাকে ফযীলাতপূর্ণ অথবা হারাম মনে করা বিদআত, কেননা এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে বাড়াবাড়ি।
একাদশ নীতি: যে সকল আকীদাহ, মতামত ও বক্তব্য আল-কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কিংবা এ উম্মাতের সালাফে সালেহীনের ইজমা‘ বিরোধী সেগুলো শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিদআত। এই নীতির আলোকে নিম্নোক্ত  দু’টি বিষয় শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিদআত ও প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে।
প্রথম বিষয়ঃ নিজস্ব আকল ও বিবেকপ্রসূত মতামতকে অমোঘ ও নিশ্চিত নীতিরূপে নির্ধারণ করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে এ নীতির সাথে মিলিয়ে যদি দেখা যায় যে, সে বক্তব্য উক্ত মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাহলে তা গ্রহণ করা এবং যদি দেখা যায় যে, কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য উক্ত মতামত বিরোধী তাহলে সে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ্র উপরে নিজের আকল ও বিবেককে অগ্রাধিকার দেয়া।
শরীয়াতের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন : “বিবেকের মতামত অথবা কিয়াস দ্বারা আল কুরআনের বিরোধিতা করাকে সালাফে সালেহীনের কেউই বৈধ মনে করতেন না। এ বিদআতটি তখনই প্রচলিত হয় যখন জাহমিয়া, মু’তাযিলা ও তাদের অনুরূপ কতিপয় এমন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যারা বিবেকপ্রসূত রায়ের উপর ধর্মীয় মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন এবং সেই রায়ের দিকে কুরআনের বক্তব্যকে পরিচালিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যখন বিবেক ও শরীয়ার মধ্যে বিরোধিতা দেখা দিবে তখন হয় শরীয়াতের সঠিক মর্ম বোধগম্য নয় বলে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা হবে অথবা বিবেকের রায় অনুযায়ী তা’বীল ও ব্যাখ্যা করা হবে। এরা হলো সে সব লোক যারা কোন দলীল ছাড়াই আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে তর্ক করে থাকে।”
ইবনু আবিল ‘ইয্ আল-হানাফী রহ. বলেন, “বরং বিদআত‘কারীদের প্রত্যেক দলই নিজেদের বিদআত ও যাকে তারা বিবেকপ্রসূত যুক্তি বলে ধারণা করে তার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে মিলিয়ে দেখে। কুরআন সুন্নাহর সে বক্তব্য যদি তাদের বিদআত ও যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে তারা বলে, এটি মুহকাম ও দৃঢ়বক্তব্য। অতঃপর তারা তা দলীলরূপে গ্রহণ করে। আর যদি তা তাদের বিদআত ও যুক্তির বিপরীত হয় তাহলে তারা বলে, এটি মুতাশাবিহাত ও আবোধগম্য, অতঃপর তারা তা প্রত্যাখ্যান করে……….অথবা মূল অর্থ থেকে পরিবর্তন করে”
দ্বিতীয় বিষয়: কোন জ্ঞান ও ইলম ছাড়াই দ্বীনী বিষয়ে ফাতওয়া দেয়া।
ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, “যারা অনিশ্চিত কোন বক্তব্যকে অন্ধভাবে মেনে নেয়ার উপর নির্ভর করে অথবা গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়াই কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়, তারা প্রকৃত পক্ষে দ্বীনের রজ্জু ছিন্ন করে শরীয়াত বহির্ভূত কাজের সাথে জড়িত থাকে। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে এ থেকে আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন। ফাতওয়ার এ পদ্ধতি আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত বিদআতেরই অন্তর্ভুক্ত, তেমনি ভাবে আকল বা বিবেককে দীনের সর্বক্ষেত্রে উড়সরহধঃড়ৎ হিসেবে স্থির করা নবউদ্ভাবিত বিদআত।”
দ্বাদশ নীতি: যে সকল আকীদা কুরআন ও সুন্নায় আসেনি এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি, সেগুলো বিদআতী আকীদা হিসেবে শরীয়তে গণ্য।
উদাহরণ :১. সুফী তরীকাসমূহের সে সব আকীদা ও বিষয়সমূহ যা কুরআন ও সুন্নায় আসেনি এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি। ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, “তন্মধ্যে রয়েছে এমন সব অলৌকিক বিষয় যা শ্রবণকালে মুরিদদের উপর শিরোধার্য করে দেয়া হয়। আর মুরীদের কর্তব্য হল যা থেকে সে বিমুক্ত হয়েছে পুনরায় পীরের পক্ষ থেকে তা করার অনুমতি ও ইঙ্গিত না পেলে তা না করা…..এভাবে আরো অনেক বিষয় যা তারা আবিষ্কার করেছে, সালাফদের প্রথম যুগে যার কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।”
২. আল্লাহর যাতী গুণাবলীর ক্ষেত্রে الجهة বা দিক নির্ধারণ, الجسم বা শরীর ইত্যাদি সার্বিকভাবে সাব্যস্ত করা কিংবা পুরোপুরি অস্বীকার করা বিদআত হিসেবে গণ্য। কেননা কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের বক্তব্যের কোথাও এগুলোকে সরাসরি সাব্যস্ত কিংবা অস্বীকার কোনটাই করা হয়নি।
এ সম্পর্কে ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, “সালাফের কেউই আল্লাহর ব্যাপারে الجسم বা শরীর সাব্যস্ত করা কিংবা অস্বীকার করার বিষয়টি সস্পর্কে কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। একইভাবে আল্লাহর সম্পর্কে الجواهر বা বস্তু এবং التحيز বা অবস্থান গ্রহণ অথবা অনুরূপ কোন বক্তব্যও তারা দেননি। কেননা এগুলো হলো অস্পষ্ট শব্দ, যদ্দ্বারা কোন হক প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং বাতিলও প্রমাণিত হয় না।…..বরং এগুলো হচ্ছে সে সকল বিদআতী কালাম ও কথা যা সালাফ ও ইমামগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।”
আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত মুজমাল ও অস্পষ্ট শব্দমালার সাথে সালাফে সালেহীনের অনুসৃত ব্যবহারিক নীতিমালা কী ছিল সে সম্পর্কে ইমাম ইবনু আবিল ইয্ আল-হানাফী রহ. বলেন, “যে সকল শব্দ (আল্লাহর ব্যাপারে) সাব্যস্ত করা কিংবা তার থেকে অস্বীকার করার ব্যাপারে নস তথা কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে তা প্রবলভাবে মেনে নেয়া উচিত। অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল শব্দ ও অর্থ সাব্যস্ত করেছেন আমরা সেগুলো সাব্যস্ত করব এবং তাদের বক্তব্যে যে সব শব্দ ও অর্থকে অস্বীকার করা হয়েছে আমরাও সেগুলোকে অস্বীকার করবো। আর যে সব শব্দ অস্বীকার করা কিংবা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে কিছুই আসেনি (আল্লাহর ব্যাপারে) সে সব শব্দের ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্য যদি বক্তার নিয়তের প্রতি লক্ষ করলে বুঝা যায় যে অর্থ শুদ্ধ, তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। তবে সে বক্তব্য কুরআন-হাদীসের শব্দ দিয়েই ব্যক্ত করা বাঞ্ছনীয়, মুজমাল ও অস্পষ্ট শব্দ দিয়ে নয়……..।”
ত্রয়োদশ নীতি: দ্বীনী ব্যাপারে অহেতুক তর্ক, ঝগড়া-বিবাদ ও বাড়াবাড়িপূর্ণ প্রশ্ন বিদআত হিসেবে গণ্য। এ নীতির মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শামিল:
১. মুতাশাবিহাত বা মানুষের বোধগম্য নয় এমন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা। ইমাম মালেক রহ.-কে এক ব্যক্তি আরশের উপর আল্লাহর استواء বা উঠার প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন “কিরূপ উঠা তা বোধগম্য নয়, তবে استواء বা উঠা একটি জানা ও জ্ঞাত বিষয়, এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং প্রশ্ন করা বিদআত। ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, “কেননা এ প্রশ্নটি ছিল এমন বিষয় সম্পর্কে যা মানুষের জ্ঞাত নয় এবং এর জবাব দেয়াও সম্ভব নয়।” তিনি অন্যত্র বলেন, “ استواءবা আরশের উপর উঠা সম্পর্কে ইমাম মালেকের এ জবাব আল্লাহর সকল গুণাবলী সম্পর্কে ব্যাখ্যা হিসেবে পুরাপুরি যথেষ্ট
২। দীনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কিছু নিয়ে গোঁড়ামি করা এবং গোঁড়ামির কারণে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করা বিদআত বলে গণ্য।
৩। মুসলমানদের কাউকে উপযুক্ত দলীল ছাড়া কাফির ও বিদআতী বলে অপবাদ দেয়া।
চতুর্দশ নীতি: দ্বীনের স্থায়ী ও প্রমাণিত অবস্থান ও শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে পরিবর্তন করা বিদআত।
উদাহরণ :১। চুরি ও ব্যভিচারের শাস্তি পরিবর্তন করে আর্থিক জরিমানা দণ্ড প্রদান করা বিদআত।
২। যিহারের কাফ্ফারার ক্ষেত্রে শরীয়াতের নির্ধারিত সীমারেখা পাল্টে আর্থিক জরিমানা করা বিদআত।
পঞ্চদশ নীতি: অমুসলিমদের সাথে খাস যে সকল প্রথা ও ইবাদাত রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে সেগুলোর অনুসরণ বিদআত বলে গণ্য।
উদাহরণ :কাফিরদের উৎসব ও পর্ব অনুষ্ঠানের অনুকরণে উৎসব ও পর্ব পালন করা। ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, “জন্ম উৎসব, নববর্ষ উৎসব পালনের মাধ্যমে অমুসলিমদের অনুকরণ নিকৃষ্ট বিদআত।”

শেষ কথা


বিদআতের সংজ্ঞা প্রদানের পাশাপাশি বিদআতের মৌলিক ও সাধারণ কিছু নীতিমালা আমরা এখানে আলোচনা করলাম। আশা করি সকলেই এগুলো ভালভাবে জেনে নেবেন এবং উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন। পরবর্তী করণীয় হল এ মূলনীতিগুলোর আলোকে আমাদের নিজেদের মধ্যে কিংবা আমাদের লোকালয়ে কোন বিদআত রয়েছে কিনা তা যাচাই করা, আর যদি এখানে কোন বিদআত থেকে থাকে তাহলে আমাদের উচিত সেগুলো চিহ্নিত করা ও দেশবাসীকে তা অবহিত করা এবং নিজেরা সেগুলো ত্যাগ করা ও অন্যদেরকেও তা ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে মুসলিম হিসেবে আমরা সকলেই কম-বেশী অবদান রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন!!