প্রশ্ন:
যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভালোবাসে সে কি জাহান্নামে প্রবেশ করবে? অনেক ইহুদী ও খ্রিস্টান কাফের আছে যারা আল্লাহ্কে ভালোবাসে। অনুরূপভাবে পাপী মুসলিমও আল্লাহ্কে ভালোবাসে। সে কখনও বলে না যে, আমি আল্লাহ্কে ঘৃণা করি। এ বিষয়টি কি একটু ব্যাখ্যা করা যায়?
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) এ মাসয়ালাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: ভালোবাসা চার প্রকার। এ প্রকারগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে জানা আবশ্যকীয়। এ ভালোবাসাগুলোর মাঝে পার্থক্য করতে না পারার কারণে যারা পথভ্রষ্ট হওয়ার তারা পথ ভ্রষ্ট হয়েছে:
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) এ মাসয়ালাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: ভালোবাসা চার প্রকার। এ প্রকারগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে জানা আবশ্যকীয়। এ ভালোবাসাগুলোর মাঝে পার্থক্য করতে না পারার কারণে যারা পথভ্রষ্ট হওয়ার তারা পথ ভ্রষ্ট হয়েছে:
১. আল্লাহ্কে ভালোবাসা। শুধু এই ভালোবাসা আল্লাহ্ থেকে ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং সওয়াব লাভে সফলকাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ মুশরিকেরা, ক্রুশ-পূজারীরা, ইহুদীরা এবং অন্যান্য অনেকে আল্লাহ্কে ভালোবাসে।
২. আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসেন সেটাকে ভালোবাসা। এই ভালোবাসা ব্যক্তিকে ইসলামে প্রবেশ করায় ও কুফর থেকে বের করে আনে। এই ভালোবাসা সর্বাধিক প্রতিষ্ঠাকারী ব্যক্তি আল্লাহ্র কাছে সর্বাধিক প্রিয়।
৩. আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা। এই ভালোবাসা দ্বিতীয় প্রকারের ভালোবাসার সম্পূরক। ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’ ব্যতীত আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসেন সেটাকে ভালোবাসা যথাযথ হতে পারে না।
৪. আল্লাহ্র সাথে ভালোবাসা। এটি শির্কপূর্ণ ভালোবাসা। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে ভালোবাসে; আল্লাহ্র জন্যেও নয়, আল্লাহ্র কারণেও নয়– তবে সে ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করল। এটাই হচ্ছে মুশরিকদের ভালোবাসা।
পঞ্চম প্রকার আরেকটি ভালোবাসা আছে সেটা আমরা যে বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছি সেটার মধ্যে পড়ে না। সে ভালোবাসা হচ্ছে মানুষের সহজাত ভালোবাসা। তা হচ্ছে- মানুষের প্রবৃত্তির সাথে যা কিছু খাপ খায় সেটার প্রতি টান। যেমন পিপাসার্ত ব্যক্তি পানিকে ভালোবাসে। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাবার ভালোবাসে। ঘুম, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। এ ধরণের ভালোবাসা নিন্দনীয় নয়; যদি না সেটা ব্যক্তিকে আল্লাহ্র যিকির থেকে ও তাঁর ভালোবাসা থেকে দূরে না রাখে। তাইতো আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: “হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে দূরে না রাখে।”। [সূরা মুনাফিকুন, আয়াত: ৯] আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “এমন লোকেরা, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর যিকির থেকে, নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে দূরে না রাখে।” [সূরা নূর, আয়াত: ৩৭] [1]
তিনি আরও বলেন: আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহ্র সাথে ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য: এ পার্থক্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন, বরং জরুরী এ ভালোবাসাদ্বয়ের মাঝে পার্থক্য জানা। কারণ আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা ঈমানের পূর্ণতার অংশ। আর আল্লাহ্র সাথে ভালোবাসা নিরেট শির্ক। এ দুটোর মাঝে পার্থক্য হলো–
আল্লাহ্র জন্য ভালাবাসা আল্লাহ্র ভালোবাসারই অনুবর্তী। কেননা বান্দার অন্তরে যখন আল্লাহ্র ভালোবাসা স্থান করে নেয় তখন এ ভালোবাসা আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসেন সেসবকেও ভালোবাসা অবধারিত করে তোলে। আর যখন বান্দা আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসে সেটাকে ভালোবাসে; তখন সে ভালোবাসাটা হয় আল্লাহ্র জন্য বা আল্লাহ্র কারণে। যেমন–
বান্দা আল্লাহ্র রাসূলগণকে ভালোবাসে, তাঁর নবীগণকে ভালোবাসে, তাঁর ফেরেশতাগণকে ভালোবাসে, তাঁর বন্ধুগণকে ভালোবাসে; কারণ আল্লাহ্ এদেরকে ভালোবাসেন। আর আল্লাহ্ যাদেরকে ঘৃণা করেন; আল্লাহ্ ঘৃণা করার কারণে সেও তাদেরকে ঘৃণা করে। আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহ্র জন্য ঘৃণা করার আলামত হচ্ছে– আল্লাহ্র কোন শত্রু যদি তার প্রতি কোন ইহসান করে, তার কোন সেবা করে, তার কোন প্রয়োজন পূরণ করে দেয় তদুপরি ঐ শত্রুর প্রতি তার ঘৃণাবোধ ভালোবাসাতে রূপান্তরিত হয় না। অনুরূপভাবে আল্লাহর কোন প্রিয় ব্যক্তি যদি তাকে ঘৃণা করে কিংবা কষ্ট দেয়; হয়তো ভুলক্রমে বা তার ব্যাপারে আল্লাহ্র আনুগত্য করতে গিয়ে ইচ্ছা করে, বা ভুল-ব্যাখ্যার বশবর্তী হয়ে বা ইজতিহাদগত কারণে কিংবা বিদ্রোহবশতঃ যা থেকে ঐ ব্যক্তি তওবা করেছে; তদুপরি তার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল সেটা ঘৃণাতে রূপান্তরিত হয় না।
গোটা দ্বীন ভালোবাসা ও ঘৃণা-র এ চারটি নীতির উপর আবর্তিত হয়। এ দুটোর উপর কিছু কর্ম করা ও কিছু কর্ম না করা নির্ভর করে। যে ব্যক্তির ভালোবাসা, ঘৃণা, পালন ও বর্জন আল্লাহ্র জন্য সে ব্যক্তি তার ঈমানকে পূর্ণতা দান করেছে। অর্থাৎ ভালবাসলে আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসে। ঘৃণা করলে আল্লাহ্র জন্য ঘৃণা করে। কিছু করলে আল্লাহ্র জন্য করে। কিছু বর্জন করলে আল্লাহ্র জন্য বর্জন করে। এ চারটি শ্রেণীর মধ্যে যে অনুপাতে ঘাটতি হবে তার ঈমান ও দ্বীনদারিতেও সে অনুপাতে ঘাটতি হবে।
এর বিপরীতে রয়েছে আল্লাহ্র সাথে ভালোবাসা। সেটা দুই প্রকার: এক প্রকার যা ব্যক্তির মূল তাওহিদের উপর আঘাত হানে। আর অন্য প্রকার যা পরিপূর্ণ একনিষ্ঠতা ও আল্লাহ্র ভালোবাসার উপর আঘাত হানে; কিন্তু ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না।
প্রথম প্রকার: যেমন– মুশরিকগণ কর্তৃক তাদের মূর্তিগুলোকে ও আল্লাহ্র শরীকদারগুলোকে ভালোবাসা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মত ভালোবাসে।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৬৫] এ সকল মুশরিকগণ তাদের প্রতিমা, মূর্তি ও উপাস্যগুলোকে আল্লাহ্র সাথে ভালোবাসে; যেভাবে তারা আল্লাহ্কে ভালোবাসে। এ ধরণের ভালোবাসা হচ্ছে- উপাসনা ও মৈত্রী শ্রেণীর ভালোবাসা; যে ভালোবাসার অনুবর্তী ভয়, আশা, ইবাদত ও দোয়া। এ ধরণের ভালোবাসাই– শির্ক; আল্লাহ্ যা ক্ষমা করবেন না।
এই শরীকদার উপাস্যদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা ও এদেরকে চরম ঘৃণা করা ছাড়া, এদের পূজারীদেরকে ঘৃণা করা ও তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা ছাড়া ঈমান অর্জিত হবে না। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আল্লাহ্ তাঁর রাসূলগণকে পেরণ করেছেন, তাঁর কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন, এই শির্কী ভালোবাসাপোষণকারীদের জন্য জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন। এই ভালোবাসা পোষণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইকারী ও তাঁর কারণে এদের সাথে শত্রুতা পোষণকারীদের জন্য জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র আরশ থেকে শুরু করে জমিন পর্যন্ত অন্য যা কিছুর উপাসনা করবে সে ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত সেটাকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করল এবং তাঁর সাথে শির্ক করল; সে উপাস্য যেই হোক না কেন। সে উপাস্য থেকে বান্দা নিজের বৈরিতা ঘোষণা করা কতই প্রয়োজন।
দ্বিতীয় প্রকার: আল্লাহ্ তাআলা মানব অন্তরে যা কিছু সুশোভিত করেছেন সেগুলোর প্রতি ভালোবাসা; যেমন– নারী, সন্তানসন্ততি, স্বর্ণ-রৌপ্য, ভাল জাতের সুন্দর ঘোড়া, গবাদি পশু (উট, গরু, ভেড়া ও ছাগল), জমি। জৈবিক চাহিদা থেকে এগুলোর প্রতি ভালোবাসা। উদাহরণতঃ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবারের প্রতি ভালোবাসা। পিপাসার্ত ব্যক্তির পানির প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসা তিন ধরণের হতে পারে:
1. বান্দা যদি আল্লাহ্র কাছে পৌঁছা, তাঁর সন্তুষ্টি ও আনুগত্য সম্পাদনের উপকরণ হিসেবে এগুলোকে ভালোবাসে তাহলে এ ভালোবাসার জন্য সে সওয়াব পাবে। এবং এ ভালোবাসা আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসার অধিভুক্ত হবে। এগুলোকে উপভোগ করে বান্দা স্বাদ পাবে। এটাই ছিল ইনসানে কামেলের অবস্থা যার কাছে দুনিয়ার জিনিসের মধ্যে: নারী ও সুগন্ধি প্রিয় ছিল। তিনি এ দুটোকে ভালবাসতেন আল্লাহ্র ভালোবাসার সহায়ক হিসেবে, তাঁর রিসালাত ও নির্দেশ পৌঁছে দেয়ার সহায়ক হিসেবে।
2. আর যদি বান্দা এ জিনিসগুলোকে তার সহজাত স্বভাব, প্রবৃত্তি ও ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে ভালোবাসে এবং আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসেন ও যা কিছুতে সন্তুষ্ট হন সেগুলোর উপর এগুলোকে প্রাধান্য না দেয়; বরং প্রকৃতিগত টানের কারণে এগুলো অর্জন করে থাকেন তাহলে এ ভালোবাসা বৈধ বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত। এর জন্য বান্দাকে কোন শাস্তি পেতে হবে না। তবে, আল্লাহ্র জন্য ও আল্লাহ্র কারণে যে ভালোবাসা সেটার পূর্ণতার মধ্যে কিছুটা ঘাটতি থাকবে।
3. আর যদি এগুলো অর্জনই বান্দার চূড়ান্ত টার্গেট হয়, তার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, চেষ্টা-প্রচেষ্টা সব এগুলো অর্জনের পিছনে এবং আল্লাহ্ যা কিছুকে ভালোবাসেন, যা কিছুর প্রতি সন্তুষ্ট হন সেগুলোর উপর এগুলো অর্জন করাকে প্রাধান্য দেয় তাহলে এ ব্যক্তি নিজের উপর জুলমকারী ও নিজের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণকারী।
প্রথমটা হচ্ছে অগ্রসর ঈমানদারদের ভালোবাসা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে মধ্যমমানের ঈমানদের ভালোবাসা, আর তৃতীয়টি জালেম তথা গুনাহগার ঈমানদারদের ভালোবাসা।[2]
আমাদের নবী মুহাম্মদ-এর উপর আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হোক।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।